রেশন নিয়ে মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। বরাদ্দে কম, ওজনে কারচুপি, দাম বেশি নেওয়া, পাকা রসিদ না দেওয়া তালিকা বড় দীর্ঘ। রেশন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ দূর করতে তাই কড়া কিছু পদক্ষেপ করল মুর্শিদাবাদ জেলার খাদ্য ও সরবরাহ দফতর। নানা রকমের দুর্নীতির অভিযোগে দফতর গত দু’ মাসের মধ্যে জেলার ৫৭ জন রেশন ডিলারকে জরিমানা করেছে। এ ছাড়াও গণবণ্টন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে দফতর। তৈরি হচ্ছে মডেল রেশন দোকানযেখানে গ্রাহকদের বসার বন্দোবস্ত থাকবে। কড়া নজরদারির ফল হাতেনাতে মিলছে বলেই দাবি প্রশাসনের। তবে, জেলাবাসীর মতে, উপর-উপর কিছু পরিবর্তন হলেও রেশনে দুর্নীতি চলছে আগের মতো। |
মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৩৭৪টি রেশন দোকান রয়েছে। খাদ্য ও সরবরাহ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সপ্তাহে পাঁচ দিন এক বেলা রেশন দোকান খোলা রাখার কথা। কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় আগে দেড় (এক দিন আর এক বেলা) থেকে দু’দিন খুলত রেশন দোকানগুলি। এখন সেখানে কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে চার দিন দোকান খুলে রাখার কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাথা পিছু কেরোসিন তেল, চাল, গম, ময়দা ও চিনি সঠিক ভাবে দিতে ডিজিটাল ওজনযন্ত্র আবশ্যিক করা হয়েছে। সঙ্গে চলছে কঠোর নজরদারি। জেলা আধিকারিক বা ব্লক স্তরের আধিকারিকরা হঠাত্ই চলে যাচ্ছেন রেশন দোকানে। ত্রুটি চোখে পড়লেই শো-কজের পর জরিমানা করা হচ্ছে। ত্রুটির নিরিখে তা কমপক্ষে ১৫ হাজার। এই ভাবেই গত দু’মাসে বহু রেশন ডিলারের জরিমানা হয়েছে। রেশন ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক কৃষ্ণচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক কালে প্রশাসনের কিছু কড়া পদক্ষেপের ফলে ডিলাররাও সতর্ক হচ্ছেন। ফলে দুর্নীতি কমছে রেশন ব্যবস্থায়।” একমত জঙ্গিপুর মহকুমা রেশন ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও রাজ্য কমিটির সদস্য নীলরতন দাসও।
মুর্শিদাবাদ জেলা খাদ্য ও সরবরাহ নিয়ামক ভাস্কর হালদার বলেন, “নজরদারি বাড়ানোয় রেশন গ্রাহকরা উপকৃত হয়েছেন। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে জেলায় কিছু মডেল রেশন দোকান চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ওই দোকানগুলিতে পানীয় জল সরবরাহ ও গ্রাহকদের বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে বড় লাইনে দাঁড়ানোর ভয়ে গ্রাহকরা রেশন না নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।” তিনি আরও জানান, সম্প্রতি ১০৪ টাকা দামে ভাল তাঁতের শাড়ি দেওয়া হয়েছে রেশনে। এ ছাড়াও অন্য অনেক জিনিসপত্র দেওয়া হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে রেশনে কী কী দেওয়া হবে, তা এলাকার ১০ জনকে এসএমএস করে জানানোর কথা ডিলারদের। সেই সংখ্যাটা বাড়িয়ে ২০ করা হয়েছে।”
প্রশাসনের নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা হচ্ছে বলে দাবি রেশন ডিলারদের। ডোমকলের রেশন ডিলার সুরাবুদ্দিন বলেন, “এখন এলাকার বিশিষ্ট ২০ জনকে এসএমএস করি। ফলে অনেক বেশি লোকজন আগে থেকেই জেনে যাচ্ছেন, রেশনে কী কী মিলবে।” যদিও ১০-২০ তো পরের কথা, এক জনকেও এসএমএস করা হয় কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে লোকজনের মধ্যে। কান্দির বাসিন্দা প্রলয় হাজরা বলেন, “আমি জানি না, আমাদের এলাকার ডিলার কাউকে এসএমএস করে কি না। যেখানে কী কী পাওয়া যাবে, তার তালিকাই রেশন দোকানে থাকে না, সেখানে এসএমএস পর্যন্ত আমি ভাবতেও পারি না।” বস্তুত সপ্তাহের নির্ধারিত রেশন সামগ্রীর তালিকা না টাঙানো নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সর্বত্র। বেলডাঙা থানার কালীতলার বাসিন্দা সোমনাথ হালদার বলেন, “আমরা কোন সপ্তাহে কত করে কেরোসিন পাব, তা রেশন দোকানে লেখা থাকছে না। অন্য জিনিসপত্রের কথা বাদ দিলাম। কী পাওয়ার কথা, তা-ই জানি না। ফলে ঠকছি না জিতছি বুঝব কী করে?”
রেশন দোকান আগের চেয়ে বেশি সময় খোলা থাকছেএটা বলছেন অনেকেই। তবে, চার দিন রেশন দোকান খোলা থাকছে না প্রায় কোথাও। নওদা থানার কেদারচাঁদপুরের গুলাম আলি বলেন, “আমাদের এখানে তিন দিনমূলত শুক্র, শনি, রবি খোলা থাকছে। চার দিন রেশন দোকান খোলা পাওয়াটা এই জীবনে দেখে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।” কারচুপি আর দুর্নীতিও বিশেষ কিছু কমেছে বলে মনে করছেন না জেলাবাসী। কান্দি অঞ্চলের বাসিন্দা রূপম দাস বলেন,‘‘সব ঠিকঠাক চলছে বলা যাবে না। এক সময়ে রেশনে খুব চুরি হত। লোকজন সচেতন হওয়ার ফলে ডিলাররা এখন আর বেশি কারচুপি করতে পারেন না ঠিক। প্রশাসনও কিছু পদক্ষেপ করছে। তবে, দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।”
রেশন ডিলারদের আবার বক্তব্য, লাভ বেশি না থাকার কারণেই কারচুপি করতে হয় তাঁদের। বেলডাঙার এক রেশন ডিলার বলেন,‘‘দোকানের ভাড়া, বিদ্যুতের খরচ, কর্মীর বেতনসব দিয়ে এই দুর্মূল্য বাজারে হাতে আর কিছু থাকে না। তার জন্যই একটু-আধটু কারচুপি করতে হয় আমাদের।” কারচুপি চলবেই। নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে গ্রাহকদের। |