সম্পাদক সমীপেষু...
আর্সেনিক ও গরিব
পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলে প্রথম আর্সেনিক দূষণের কথা জানা যায় আশির দশকে। সালটা ১৯৮৩। প্রথম দিকে সমস্যাটির সত্যতা সহজে স্বীকার করতে না-চাইলেও পরবর্তী কালে এই সমস্যাটির ভয়াভয়তা স্বীকার করতে বাধ্য হয় সরকার। এর পিছনে ভূমিকা ছিল বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ ফল, সমীক্ষা এবং সংবাদ মাধ্যমে তার প্রতিনিয়ত প্রতিফলন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, জনস্বার্থ মামলা, পোলিয়ো বয়কট থেকে শুরু করে পথ অবরোধ, আর্সেনিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন, মন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো ইত্যাদি, ইত্যাদি। কত হই চই। তখন অবশ্য খাদ্য-শৃঙ্খলেও যে আর্সেনিক দূষণের সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে সে বিষয়ে ধারণা ছিল না। পরবর্তী কালে গবেষণায় দেখা যায় যে, আর্সেনিক আক্রান্ত জেলাগুলিতে ফসলের মধ্যেও আর্সেনিকের বিষ ঢুকে পড়েছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আর্সেনিক-নিরাপদ, উচ্চফলনশীল বিকল্প ধানের বীজ আবিষ্কার করেছেন (আবাপ ৩১-১২-২০১৩ এবং ২৯-১-’১৪)। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বীজের নামকরণ করেছেন ‘মুক্তশ্রী’।
এ হেন ধানের বীজ আর্সেনিক আক্রান্ত ও অনাক্রান্ত এলাকার মানুষের কাছে খুবই সুখবর। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ‘মুক্তশ্রী’ কি আদৌ গরিব মানুষগুলিকে আর্সেনিক বিষের থাবা থেকে মুক্ত করতে পারবে?
মুর্শিদাবাদ জেলার আর্সেনিক আক্রান্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সমস্ত সরু, লম্বা, সুগন্ধী দেখতে সুন্দর চালের বাজারে চাহিদা আছে তার প্রায় সমস্তটাই বিক্রি করে দেওয়া হয় বাজারে এবং পরে তা মিলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন শহরাঞ্চলে। বাজারে প্রবেশ করার পর সচেতন শহুরে মানুষজনের মধ্যে অচিরেই যে বিকল্প ধানের বীজের চালের চাহিদা বাড়বে, তা বলার অবকাশ রাখে না। আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়বে এর কদর। অর্থনীতিবিদ জে বি সে কথিত বিখ্যাত ‘সে’জ ল’ সূত্রটি (সাপ্লাই ক্রিয়েটস ইট’স ওন ডিমান্ড) সহজেই কার্যকর হবে এ ক্ষেত্রে। এখন যদি সরকারি তত্‌পরতায় কৃষকরা বিকল্প-বীজ ‘মুক্তশ্রী’র ফলন শুরু করেন, তবে বেশি উপার্জনের আশায় উত্‌পাদিত ধান বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হবে। উপকৃত হবেন মূলত উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মানুষজন। গ্রামের গরিব গেরস্তের পাতে জুটবে সেই মোটা চালের ভাত।
ঠিক যেমনটি ঘটেছে সরকারি উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে আর্সেনিকমুক্ত জল সরবরাহের ক্ষেত্রে। দীর্ঘ দিন আর্সেনিক দূষিত জল পান করেই গ্রামবাসীরা ভুগছেন নানা চর্মরোগে। দেরিতে হলেও আর্সেনিকমুক্ত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয় মূলত স্বল্পকালীন ও মাঝারি প্রকল্পের মাধ্যমে। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও গরিব মানুষের বিশেষ কোনও সুবিধা হয়নি। মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। এই সমস্ত ঘটনাই ঘটছে নিম্নবিত্তীয় অশিক্ষিত খেটে-খাওয়া মানুষের পরিবারগুলিতে। তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা থাকলেও প্রতিরোধ সংগঠিত করার ক্ষমতা নেই। এক সময় গ্রামের যে সব শিক্ষিত সচ্ছল পরিবার ভাল জলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ পয়সা দিয়ে ভাল জল পান করছেন। হয়তো সে কারণেই মনে হচ্ছে আর্সেনিক সমস্যাটির মোকাবিলা করা গেছে। কিন্তু এ ধারণা ভুল। সমস্যাটি সামনে আসার পর প্রায় তিন দশক কাটলেও গ্রামের গরিব পরিবারগুলির ক্ষেত্রে সমস্যা এখনও রয়েছে।
চিকিত্‌সার হালও খারাপ। পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক আক্রান্ত বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে সমীক্ষাপ্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানাই, এখনও কিন্তু আর্সেনিক চিকিত্‌সার জন্য মানুষকে যেতে হচ্ছে কলকাতার বদলে ভেলোরে। শারীরিক পঙ্গুত্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে আয়-উপার্জনের ক্ষমতা। অল্পবয়সি মেয়েদের হতে হচ্ছে বিধবা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিতে হচ্ছে সংসার চালানোর গুরুভার। ফলে, বঞ্চিত হচ্ছে জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে। তবে তাঁরা আজ বড় ক্লান্ত। কখনও রক্ত, কখনও মূত্র, চুল, চামড়া ইত্যাদি দিতে দিতে তাঁরা বিরক্ত। তাঁদের বক্তব্য, এত কিছু দিয়েও তো কোনও লাভ হয়নি। বরং ক্ষতি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে গ্রামের আর্সেনিক সমস্যার কথা বারংবার উঠে আসায় অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে, এমনকী জমি এবং জমির ফসল বিক্রি করতে অসুবিধে হচ্ছে। তাই আজ তাঁরা আর কিছু বলতে চান না। শুধু বলে ‘আমরা ভাল আছি’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.