লঙ্কা গুঁড়ো স্প্রে করা গর্হিত অন্যায়, কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হোক এই অশিষ্টাচারের।
কিন্তু মনমোহন সিংহের দুর্বল রাজনৈতিক কর্তৃত্বও ক্ষমাহীন। প্রশাসনের নির্বুদ্ধিতাও দেশের জন্য অগৌরবের।
জয়ন্ত ঘোষাল |
পৃথক তেলঙ্গানা বিল অনুমোদন উপলক্ষে সম্প্রতি লোকসভায় যে বেনজির তাণ্ডব দেখা গেল, যে ভাবে মনমোহন সিংহের মন্ত্রীরাই লোকসভার মেঝেতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেন, এক সাংসদ নিজেই যে ভাবে গোলমরিচ স্প্রে ছড়িয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তার নিন্দা দলমত নির্বিশেষে সকলেই করেছেন, করছেন এবং করবেন। কিন্তু অন্য একটি প্রশ্ন এই বিষয়ে উত্থাপন করাটা উচিত বলে মনে হচ্ছে। সেটি হল, ভোটের মুখে তড়িঘড়ি যে ভাবে এই বিলটি যথেষ্ট রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই অনুমোদন করানোর চেষ্টা চলছে সেটিও কি যথেষ্ট অগণতান্ত্রিক এবং সুষ্ঠু প্রশাসনিকতার অভাব নয়? এক দিকে প্রবল বিক্ষোভের মধ্যে যেন তেন প্রকারেণ সরকার তেলঙ্গানা বিল উত্থাপন করছে, অন্য দিকে জয়রাম রমেশের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন, সুষ্ঠু আলোচনা না করে তাড়াহুড়ো করে বিল পাশ করানোর চেষ্টাই উচিত নয়। |
তেলঙ্গানা নিয়ে মনমোহন সিংহের সরকারের দীর্ঘ টালবাহানার পটভূমি ও প্রধানমন্ত্রীর দুর্বল কর্তৃত্বের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রশাসনিক পঙ্গুতা ও সুষ্ঠু রাজনীতির অভাবও সাংসদদের প্রতিক্রিয়াকে আজ এতখানি তীব্র এবং অশালীন করে তুলেছে। এনডিএ জমানায় অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনটি নতুন রাজ্য তৈরি হয়। ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরাঞ্চল। সে দিনও রাজ্য বিভাজন নিয়ে রাজনৈতিক ওজর-আপত্তি ছিল। কিন্তু মনে আছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী প্রতিটি দলের নেতাদের সঙ্গে বার বার আলোচনা করে ঐকমত্য গড়ে তুলেছিলেন। বিজেপি-আর এস এস তথা সঙ্ঘ পরিবার সর্বদাই শক্তিশালী ভারতীয় হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে। তাই এই রাজ্যভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্রের ধারণায় আঘাত করবে কি না তা বোঝানো ছিল এক মস্ত বড় দায়। মনে পড়ছে, উত্তরাখণ্ডে স্লোগান ছিল ‘ভারত দেশ রহে অখণ্ড, লেকিন রহেঙ্গে উত্তরাখণ্ড।’ বিজেপি সর্বত্র প্রচার করেছিল: জয় উত্তরাখণ্ড, জয় ভারত। |
ভারত চিরকালই এক জটিল বহুত্ববাদী দেশ। নেহরুর মতো রাজনেতাও বার বার ভয় পেতেন যে রাজ্য পুনর্গঠনের চেষ্টায় জাতীয়তাবাদী ভারত খণ্ডবিখণ্ড না হয়ে যায় নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধে। ১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর নেহরু সংসদে রাজ্য পুনর্গঠনের জন্য কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট দেওয়ার সময়সীমা ছিল। তখনকার দিনেই কমিশন ১,৫২,২৫০টি লিখিত মতামত-টেলিগ্রাম-চিঠি গ্রহণ করেছিলেন। কমিশন ১০৪টি স্থানে যান মতামত সংগ্রহে। ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়াও, ৩০ হাজার মাইল ঘুরে ৯০০০ মানুষের সরাসরি মতামত নেওয়া হয়।
সমস্যা কিন্তু মেটেনি। ১৯৫৬ সালে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হয়। সে দিনও তেলঙ্গানা এই অন্ধ্রের অংশ হয়ে থাকতে চায়নি। স্বাধীনতার সময় যখন তেলঙ্গানা নিজামের শাসনের অধীন ছিল তখনও স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা ছিল, অন্ধ্রপ্রদেশের অন্য প্রান্তের বেশি শিক্ষিত ও ধনী অভিবাসীদের হাতে তেলঙ্গানার মানুষ নিগৃহীত হতে পারে। ১৯৬৯ সালে পৃথক তেলঙ্গানা আন্দোলনে ৪০০ লোকের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে আন্দোলন সফল হয়নি।
বিজেপি তিনটি পৃথক রাজ্যের জন্ম দিলেও তেলঙ্গানায় হাত দেয়নি। কারণ চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম ছিল বিজেপির শরিক দল এবং টিডিপি ছিল পৃথক তেলঙ্গানার বিরুদ্ধে। বিধানসভায় ঐকমত্য না হওয়ায় বিজেপি এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এ বার মনমোহন সিংহের সরকার কী করলেন? প্রথম দিকে কংগ্রেস পৃথক তেলঙ্গানার বিরুদ্ধেই মতামত দিচ্ছিলেন। তেলঙ্গানার সমস্যা নিয়ে তত্কালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে যখন ওই অঞ্চলের সাংসদেরা দেখা করে বলেন, পৃথক রাজ্য না হলে তেলঙ্গানার সাংসদরা আত্মহত্যা করবেন। তখন প্রণববাবু বলেছিলেন, তেলঙ্গানার সমস্ত সাংসদ আত্মহত্যা করলে পৃথক রাজ্য দেওয়া হবে, এটা যুক্তি হতে পারে না। পৃথক রাজ্যের বিষয়ে সব পক্ষের ঐকমত্য ছাড়া এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দেও এক বার বলেছিলেন, পৃথক তেলঙ্গানা করে লাভ কী? ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরম এক বার ‘পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্য হবে’ বলে বিবৃতি দিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলেন। এ দিকে লোকসভার নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে লাগল, প্রয়াত রাজশেখর রেড্ডির পুত্র জগন জেলে গিয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন বেশি বেশি করে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী কিরণ রেড্ডিরও পৃথক তেলঙ্গানার বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব না নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় কংগ্রেস হাই কমান্ডের মনে হয়, বরং তেলঙ্গানার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটে ওই অঞ্চলের সাংসদদের পাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করাই ভাল। তাতে সীমান্ত অঞ্চলের কংগ্রেস ভোট যায় তো যাক।
এই রাজনৈতিক কৌশল বা ঝুঁকি গ্রহণের রাজনীতি সফল করতে গেলে প্রয়োজন ছিল এক জন শক্তিশালী কান্ডারির। মনমোহন সিংহ যে দুর্বল নেতা সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ও সাধারণ ভাবে নীতিপঙ্গুতা গোটা দেশে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি এক চূড়ান্ত অনাস্থা তৈরি করেছে সমগ্র দেশ জুড়ে। এ অবস্থায় তেলঙ্গানা বিরোধী দলীয় রাজনীতিক শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মতো নেতৃত্ব কোথায়? রাহুল গাঁধী এখনও ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নন। দলের সভানেত্রী এখনও সনিয়া গাঁধী। সরকারের প্রধান প্রতিভূ কিন্তু এখনও মনমোহন সিংহ। ফলে নেতৃত্বের প্রশ্নে এখনও ধোঁয়াটে। স্পষ্ট হয়েও অস্পষ্ট।
তা ছাড়া কংগ্রেস তো কোনও আঞ্চলিক দল নয়। সর্বভারতীয় কংগ্রেস তেলঙ্গানায় এক রকমের অবস্থান, সীমান্ধ্র এলাকায় আর এক রকমের অবস্থান নেবেন কী করে? সেটা কি সম্ভব? সেটা কি উচিত? দার্জিলিঙে কংগ্রেস যদি পৃথক দার্জিলিং রাজ্যের দাবিতে সরব হয় এবং কলকাতায় বসে রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরী পশ্চিমবাংলাকে ভাগ হতে দেবেন না বলেন, তা হলে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কি প্রশ্ন উঠবে না?
গণতন্ত্রে বিতর্ক থাকবেই। নিরন্তর আলাপ-আলোচনাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। কিন্তু পেন্ডুলামের মতো এক বার ইহাও হয় আর এক বার উহাও হয় এই করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যে চূড়ান্ত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গাফিলতি দেখালেন, ভোটের রাজনীতির স্বার্থে চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটিকেও সুষ্ঠু ভাবে বাস্তবায়িত করতে নিজের দলকেই সামলাতে পারলেন না, হাবুডুবু খেলেন, তীব্র ভাষায় তারও প্রতিবাদ জানানোর সময় এসেছে। লঙ্কা গুঁড়ো স্প্রে করা গর্হিত অন্যায়, কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হোক এই অশিষ্টাচারের। কিন্তু মনমোহন সিংহের দুর্বল রাজনৈতিক কর্তৃত্বও ক্ষমাহীন। প্রশাসনের নির্বুদ্ধিতাও দেশের জন্য অগৌরবের।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি এ ঘটনায় দুঃখিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই, আপনি ভাল মানুষ হতে পারেন কিন্তু আপনার এই দুর্বল নেতৃত্ব দেখে আজ আমরাই অনেক বেশি দুঃখিত। |