|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
তিনি সত্যিই পরিচালকের অভিনেতা |
শিলাদিত্য সেন |
দ্য মাস্টার অ্যান্ড আই/ সৌমিত্র অন সত্যজিৎ, সৌমিত্র চ্যাটার্জি। সুপারনোভা, ৩৯৫.০০ |
অপুর সংসার’-এর (১৯৫৯) পর থেকেই অন্য পরিচালকদের ছবিতে অভিনয়-করা শুরু করেন সৌমিত্র, সে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ যেমন করতেন না সত্যজিৎ, তেমন আবার উদাসীনও থাকতেন না। বরং উৎসাহ দিতেন, অভিভাবকের মতোই। তপন সিংহ যখন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ (১৯৬০) অভিনয়ের জন্য ডাকলেন, সে-কথা সত্যজিৎকে জানাতেই তিনি বললেন ‘অফকোর্স ইউ শ্যাল অ্যাক্ট ইন হিজ ফিল্ম’। পরে তপনবাবুর মুখ থেকেই শুনেছিলেন সৌমিত্র— ‘অপুর সংসার’ নিয়ে সত্যজিৎকে নিজের ভাললাগা জানানোর সময় তপনবাবু সৌমিত্রর অভিনয়েরও প্রশংসা করেন। শুনে সত্যজিৎ বলেন, ‘উই হ্যাভ ফাইনালি ফাউন্ড ওয়ান আফটার অল দিস টাইম, ডোন্ট ইউ থিংক?’
এ মন্তব্য থেকে স্বাভাবিক ভাবেই স্পষ্ট হয়ে আসে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আদতে পরিচালকের অভিনেতা— ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর। শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমা যতই সমবায়ী হোক-না-কেন শেষ পর্যন্ত তা পরিচালকেরই ছবি। ছবি তৈরির বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন জনের কমর্র্কুশলতা যুক্ত হতে থাকে, কিন্তু পরিচালকের ভূমিকা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অপরিহার্য। আর সেই পরিচালক যখন চিত্রনাট্য লেখেন, বা কোনও চরিত্রকে কল্পনা করেন, তখন তার কথা-বলা হাঁটা বসে-পড়া উত্তেজিত-হওয়া— যাবতীয় ভঙ্গি ভেবে ফেলেন। সৃষ্টিশীল পরিচালকের ছবিতে কোনও চরিত্র একমাত্রিক হয় না, শিল্পের নিয়মেই তা বহুমাত্রিক। ফলে পরিচালককে এমন এক অভিনেতা বেছে নিতে হয় যিনি সেই বহুমাত্রিক চরিত্রের মধ্যে সর্বাধিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন। সে ভাবেই সৌমিত্র হয়ে উঠেছেন সত্যজিতের অভিনেতা ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর। ঠিক যেমন বার্গম্যানের ছবিতে ম্যাক্স ভন সিডো, ফেলিনির ছবিতে মার্চেল্লো মাস্ত্রোইয়ানি, বা কুরোসাওয়ার ছবিতে তোশিরো মিফুনে।
সত্যজিতের সঙ্গে সৌমিত্রর প্রথম ছবি থেকেই অদ্ভুত গভীর বোঝাপড়া। সৌমিত্র তাঁর স্বাভাবিক কল্পনায় বুঝতে পারতেন ছবিতে তাঁর চরিত্রটা সত্যজিৎ কী ভাবে ভেবেছেন, তা শেষে কোথায় দাঁড়াবে। সত্যজিৎও স্বীকার করেছেন এক সাক্ষাৎকারে: ‘সৌমিত্র নিজের থেকেই বুঝতে পারত, আমি কী চাই। কী ভাবে কোন জিনিসটা দিতে হবে।’
দ্য মাস্টার অ্যান্ড আই-তে সৌমিত্রর ভাষ্যে ধরা পড়েছে সেই শৈল্পিক বোঝাপড়ার ইতিবৃত্ত। ইংরেজি বইটির মূল ভিত্তি মানিকদার সঙ্গে (আজকাল, ১৯৯৩)। এত ভাল অনুবাদ করেছেন অরুণাভ সিংহ যে বইটি পড়তে-পড়তে যেন সৌমিত্রর লাবণ্যময় বাক্ভঙ্গি শুনতে পাওয়া যায়। মুখবন্ধে শর্মিলা ঠাকুরও বলেছেন: ‘আই ক্যান অলমোস্ট হিয়ার সৌমিত্র স্পিক’। বইটা নিয়ে বলেছেন: ‘আ মাস্ট-রিড ফর এনিওয়ান হু ওয়ান্টস অ্যান ইনসাইট ইনটু ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট কোলাবরেশনস ইন সিনেমাটিক হিস্ট্রি।’
সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর চোদ্দটি কাহিনিচিত্র ও দু’টি তথ্যচিত্রে কাজ করেছেন সৌমিত্র, এ পরিসংখ্যানই বলে দেয় কতটা সৌমিত্র-নির্ভর ছিলেন সত্যজিৎ। মুদ্রণ পারিপাট্যে উজ্জ্বল এ-বইয়ের প্রায় পাতায়-পাতায় ছবি। সত্যজিতের সিনেমায় সৌমিত্র-সংক্রান্ত নানান স্থিরচিত্র, স্কেচ, পোস্টার— সাধুবাদ প্রাপ্য ‘রে সোসাইটি’র।
তবে সৌমিত্রর বাংলা রচনাদি হাতড়ালে বেশ কিছু লেখা আর সাক্ষাৎকার মিলবে সত্যজিৎকে ঘিরে। একটি প্রবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— ‘অপু থেকে গঙ্গাচরণ’। এমন কিছু লেখা যদি পরবর্তী সংস্করণে থাকে, তবে ইংরেজি ভাষার পাঠকরা ঋদ্ধ হবেন আরও। কারণ, সৌমিত্র ও তাঁর অভিনয় আজ আন্তর্জাতিক সিনেমার দর্শকের কাছে চর্চার বিষয়। |
|
|
|
|
|