|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বড় মানুষের চোখ দিয়ে ইতিহাস দেখা |
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় |
পঞ্জাব: আ হিস্ট্রি ফ্রম আওরঙ্গজেব টু মাউন্টব্যাটেন, রাজমোহন গাঁধী। আলেফ, ৬৯৫.০০ |
সাম্প্রতিক কালে পঞ্জাবের ইতিহাস চর্চার জনপ্রিয়তা কমেছে বলে খবর পাই। কয়েক বছর আগে একটি রচনা সংকলনের সম্পাদিকারা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছিলেন: বোধহয় সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন শিক্ষায়তন থেকে অখণ্ড পঞ্জাবের ইতিহাস ক্রমশ মুছে যাবে (২০১২)। তাঁদের ব্যাখ্যায় নানা প্রতিধ্বনি শুনি। ভারতীয় পঞ্জাবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্জাব চর্চার নামে যা পড়ানো ও গবেষণা হয়, সেখানে শিখ ইতিহাসের একাধিপত্য দেখা যায়। প্রতিবেশী হরিয়ানার জন্মকাল মাত্র কয়েক দশক হওয়ায় সেখানকার পণ্ডিতজনেরা রাজ্যের শিকড় খুঁজতে কখনও হরপ্পার যুগে, আবার কখনও আর্য সমাজের দয়ানন্দ সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে, শেষ পর্যন্ত জাট সম্প্রদায় ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের’ জয়গানে মুখরিত হন। প্রায় তিরিশ বছর আগে পাক পঞ্জাবের এ যুগের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজের প্রাধান্য দেখেছি। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা ধর্ম চর্চার তাগিদে প্রায়শ ক্লাসের বাইরে চলে যায় বলে শোনা যায়।
পঞ্জাব চর্চার বর্তমান চেহারার জন্যে ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত উপমহাদেশ বিভাজনকে একতরফা দায়ী করা ঠিক হবে না। স্বাধীনতোত্তর পর্বের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তিক্ততা বিষয়টিকে নিঃসন্দেহে জটিলতর করে তুলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের খাতে প্রবাহিত করতে পেরেছে। তার সঙ্গে অতীত পঞ্জাব কতটা অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ ছিল, তাই নিয়ে ইসলামি জেহাদি, গোঁড়া হিন্দু ও কট্টর শিখ পণ্ডিতদের তর্ক-বিতর্কের সীমা নেই।
রাজমোহন গাঁধী প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে পঞ্জাব রাজনৈতিক ভাবে কতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল, আর থাকলে তার চেহারা কী রকম ছিল, ইত্যাদি বিচিত্র প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চেষ্টা করেছেন। তিনি ভারতীয় বংশজ হলেও, দীর্ঘদিন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বহু দূরে থেকে বিষয়টিকে নিয়ে অনেক দিন পড়াশোনা করার পর ভারত-পাক উপমহাদেশে বার কয়েক যাতায়াত করতে করতে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার পর বইটি লিখতে উদ্যোগী হন।
তিনি প্রচলিত পঞ্জাব চর্চার ধারা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে, পুরনো দিনের নানা ধর্ম ও ভাষার বন্ধনের পঞ্জাবকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। তাঁর পঞ্জাব আঠারো শতকের প্রায় শুরু থেকে ১৯৪৭-এ দেশ বিভাজনের কাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এগারোটি পরিচ্ছেদে প্রায় আড়াইশো বছরের পঞ্জাব ইতিহাসের প্রধান পরিবর্তনের ধারাগুলিকে তিনি কেবল সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করে থেমে যাননি। পরিশিষ্ট অংশে পৃথিবীর দূর-দূরান্তের পঞ্জাবিদের এ কালের হৃদয়বেদনা ও প্রত্যাশার কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। নানা উপাদানে গড়া ইতিহাসের কালানুক্রম নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে নিয়ে এমন এক বিরাট পঞ্জাবের ছবি এঁকেছেন, যে পঞ্জাব কোনও বিশেষ ভাষা বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর দেশ ছিল না।
রাজনৈতিক ঘটনা তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি কত বিজ্ঞ প্রশাসক, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, উদার সুফি সাধক, মহৎ কবি ও দক্ষ সৈনিকের কথা বলেছেন। তাঁর সাবলীল রচনাশৈলীর সুবাদে এক জন বিদগ্ধ রাজনীতি ও ইতিহাসের অধ্যাপকও যে মাঝে মাঝে সাহিত্যস্রষ্টার মতো সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জীবনের কথা বলতে পারেন, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল হই। তার জন্যই তো তিনি আঠারো শতকের বুলে শাহ ও ওয়ারিস শাহের হির-রন্ঝার প্রেমোপাখ্যানের কথা বলতে বলতে দেশভাগের যন্ত্রণাপ্রসূত অমৃতা প্রিতমের সৃষ্ট আরেক অনবদ্য হির-এর বেদনার কথা সমান দক্ষতার সঙ্গে উপস্থিত করতে পারেন। |
লাহৌরে আওরঙ্গজেব নির্মিত বাদশাহি মসজিদ, ডান দিকে রণজিৎ সিংহের সমাধিমন্দির।
সৈয়দ মুহম্মদ লতিফ-এর লাহৌর (সঙ্গ-ই-মিল, লাহৌর) গ্রন্থ থেকে। |
আধুনিক কালে এক খণ্ডে পঞ্জাবের ইতিহাস রচনার অন্যতম পথিকৃৎ প্রশাসক সৈয়দ মহম্মদ লতিফ (১৮৮৯)। তারপর প্রায় সোয়াশো বছর কেটে গেছে। বছর চল্লিশেক আগে লাহৌর থেকে অধ্যাপক ইকরাম আলি মালিক কিছুটা সেই চেষ্টা শুরু করেছিলেন (১৯৭০)। যদি প্রশাসক লতিফ মহারানি ভিক্টোরিয়ার যশোগান করে পঞ্জাবের ইতিহাস রচনা করে থাকেন, তবে অধ্যাপক মালিক নিজের লেখায় আঠারো শতকের পঞ্জাবের ঘটনাবলিকে তেমন কোনও প্রধান্য দেননি। কিছু দিন আগে অধ্যাপক মুজফ্ফর আলম আঠারো শতকের প্রথমার্ধের কথাতেই তাঁর যাত্রা থামিয়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে, রাজমোহন গাঁধীর লেখায় এমন এক পঞ্জাবের খবর পাই, যেখানকার সমাজজীবন কোনও এক বিশেষ জাতি ও ধর্মের উপাদানে নির্মিত হয়নি। কিন্তু সেই পঞ্জাব উনিশ শতকের শেষ তিন দশকে ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোয় দ্রুত বদলাতে থাকে। বিশ শতকের প্রথম থেকে তারা পুরনো দিনের বহু দেওয়া-নেওয়াকে আবর্জনার মতো ফেলে দিয়ে ভাগাভাগির রাজনীতিতে নিজেদের যুক্ত করে নেয়। তার জন্য ইংরেজ শাসনকে প্রধানত দোষী চিহ্নিত করে তিনি পঞ্জাব বিভাজনের জন্য জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতাদের নিন্দা করতে দ্বিধা করেননি।
তিনি কেবল এই সব ঘটনাবলি তুলে ধরবার জন্য পঞ্জাব চর্চায় এগোননি। বেশ কয়েক বছর ভারত-পাক উপমহাদেশ ও বহির্বিশ্বের বহু পঞ্জাবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাদের ভিতরকার আরেক গোপন সুরকে নিজের মনে গাঁথতে চেয়েছেন। সেই সুরটির জন্য বইটি অন্য এক মাত্রা পেয়েছে। রক্তাক্ত পঞ্জাবকে অতিক্রম করে যে-সব পঞ্জাবি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের বুকের ভিতর অহরহ এক ঘরছাড়া পথিকের বেদনার কথা শুনতে পেয়েছেন। লেখক নিজে প্রবাসী ভারতীয় বলে আরও গভীর ভাবে তাদের বিদেশের ‘নতুন ঘর’-এ বসে ‘পুরনো ঘর’ হারানোর বেদনাকে অনুভব করতে চেয়েছেন। আজকাল সেই দেশছাড়া বিরহের কথাকে অনেকে ‘পঞ্জাবিয়ত’ বলে চিহ্নিত করেন। সেখানে দেশজ গান, লোকগীতি, যন্ত্রসংগীত, নৃত্যকলা, সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, উৎসব ইত্যাদি পুনর্নির্মিত হয়ে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ায়। পরম্পরাগত ভাবে সব পঞ্জাবির সমান প্রবেশাধিকার থাকায় তার ভাষা, ছন্দ, তাল, সুর তাঁদের সব কিছু ছুঁয়ে যায়।
তবে এই সাহিত্যোপম ইতিহাসে বেশ কয়েক জায়গায় ছোটখাট ছন্দপতন ঘটেছে। তাঁর মতো পণ্ডিতের বারংবার আঁরিয়াদের মতো সাধারণ শাকসব্জি উৎপাদনকারী কৃষি সম্প্রদায় সম্বন্ধে কটূক্তি কানে লাগে এবং কিছুটা অশোভন বলে মনে হয়। অন্য বহু লেখকের লেখা থেকে প্রতি পাতায় একাধিক উদ্ধৃতি, এমনকি দু-এক জায়গায় তার মধ্যে নিজের মতো শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সমর্থনযোগ্য নয়।
সর্বোপরি তাঁর রচনায় বড় মানুষের চোখ দিয়ে পঞ্জাবের ইতিহাস ব্যাখ্যানের ঝোঁক পড়েছে, ফলে সমকালের থেকে ব্যক্তি প্রায়শ বড় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া, রাজমোহন গাঁধী যে ‘পঞ্জাবিয়ত’-এর কথা বলেছেন, সেই ‘পঞ্জাবিয়ত’ বিশ্বায়নের সুবাদে কী বিপুল পরিমাণে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, তার সম্বন্ধে তিনি নীরব কেন? ‘পঞ্জাবিয়ত’-এর সঙ্গে বলিউডের গভীর বন্ধন, তার বিষয়ে যে পরিমাণ লেখাপত্র পাওয়া যায়, তার সম্বন্ধে দু-এক কথা বললে খুব কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? |
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ভূতপূর্ব গুরু নানক অধ্যাপক |
|
|
|
|
|