নাটক সমালোচনা...
যেন রাতের ধ্রুবতারা
নেক দিন পর একটা বাংলা নাটক দেখে এত মুগ্ধ হলাম। সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘রাজা লিয়র’ দর্শনের পর। এও এক দর্শন, রাতের তারকাচ্ছন্ন আকাশে ধ্রুবতারা দর্শনের মতো। মেঘনাদ ভট্টাচার্য নির্দেশিত, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় রচিত, সায়ক গোষ্ঠীর ‘ধ্রুবতারা’। মস্ত প্রশংসা দিয়ে নাটকের আলোচনা শুরু করাটা এক ধরনের আস্কারা বোঝায়। কিন্তু আমি নিরুপায়, কারণ এমন একটা সুচিন্তিত, সুলিখিত নাটক , যা সাহিত্যসম্পদ হয়ে উঠতে পারে, এত সুপ্রযোজিত হয়ে মঞ্চস্থ হওয়ার অপেক্ষাতেই তো থাকি আমরা। যা একবার দেখার পর আবার দেখার ইচ্ছে হয়। দেখলামও। প্রথমত বিষয়। ঠিক এই সময়ের পরিবেশ ভাবনা কাহিনির পরিবেশে। প্রৌঢ় নায়ক ঋত্বিক পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশ-অবনতির সংকট নিয়ে মেতে আছেন সারা ক্ষণ। তাঁর একটু বিশ্রাম আর মনের আরাম রাতে যুবতী কন্যা অর্ণাকে আকাশের তারা চিনিয়ে। কাহিনি যত গড়ায় এই পরিবেশবিদের মনের পরিবেশটাও ক্রমশ ভাবিয়ে তোলে দর্শককে। আকাশ, জমি ও মনের রহস্যের ত্রিভুজ তৈরি হয়।
বিজ্ঞানী ঋত্বিকের মনটা সত্যিই ক্লান্ত। পরিবেশ বাঁচাতে যে প্রশাসনিক সমস্যা তাঁকে ঘিরে থাকে, তেমনই সমাজের নানা প্রতিরোধে তাঁর নিজের জীবনটাও ছিন্নভিন্ন। প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, সেই নীরবতাই ক্রমে ক্রমে যন্ত্রণা হয়েছে। সেই যন্ত্রণাই ঋত্বিককে বাক্রুদ্ধ ও অচেতন করে।
ঋত্বিকের এই অসুখ যখন শুরু, তখনই নাটকের সূচনা। এই নাটকও এক অর্থে ‘ঘরে-বাইরে’। ঘরের সংসার ও বাইরের সংসারের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে ঋত্বিক একদিন বেপাড়ায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায়। কাহিনিটির বুনোট এত পোক্ত, প্রায় গোয়েন্দা কাহিনির মতো পরতে পরতে জড়ানো, যে এর গল্প শোনানো অবিচার। গল্প, চরিত্র, পটভূমি ও তত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ‘ধ্রুবতারা’য়।
প্রথমত বিষয়, আগেই বলেছি। এবার বলি দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত এবং শেষতত বিষয়। সে বিষয় সম্পর্কের। কেতকীর স্বামী ঋত্বিক, প্রণতির প্রেমিক ঋত্বিক, অর্ণার বাবা ঋত্বিক, রণজিতের দাদা ঋত্বিক এবং ইরার ‘কাকুন’ ঋত্বিক। এ ছাড়াও আছে হেমপ্রভার পুত্র ঋত্বিক এবং মনোতোষ মাস্টারের ছাত্র ঋত্বিক। নাটকের সব চরিত্রই অদ্ভুত-অদ্ভুত সমস্যায় দাঁড়িয়ে। কারণে, অকারণে তারা কারও পক্ষে, কারও বিপক্ষে।
স্কটল্যান্ড থেকে বাড়িতে এসে ভাই রণজিতের চেষ্টা ভাইঝি অর্ণার বিয়ে পাকা করা। অর্ণা সেদিনই সদ্য আলাপ হওয়া বন্ধুকে বাড়িতে এক রাতের জন্য অতিথি করে এনেছে, কারণ ছেলেটি আহত। স্ত্রী কেতকী, বলা বাহুল্য বিরক্ত। এরই মধ্যে মনোতোষ এলেন ছাত্র ঋত্বিকের থেকে মাসের বরাদ্দ সাহায্যটুকু নিতে। পর দিন এক সময় ঋত্বিকও বেরোলেন প্রণতিকে দেখে আসতে। আপাত ভাবে রোজকার ঘটনা তা-ই জুড়ে গিয়ে এক বিশ্রী জটিলতা।
জীবনের মতো ঠিক কালো বা সাদা চরিত্র কেউ নেই ‘ধ্রুবতারা’য়। পরিস্থিতির চাপে প্রত্যেকেরই একেকটা অ্যাজেন্ডা তৈরি হয়ে যায়। কেবল নিজের অভিমত ও কৌতূহলের প্রভাবে অর্ণাই এক চোখ-খোলা, বিবেকী মানুষের নির্জনতা খুঁজে নেয়। এবং খুঁজে পায়...না থাক।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটক এত নিটোল ও নিশ্ছিদ্র যে এর জন্য মেঘনাদ ভট্টাচার্যের তুখোড় অভিনয় ও নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল সৌমিক-পিয়ালির দ্বিস্তর, আধুনিক মঞ্চায়োজন, জয় সেনের কখনও ক্ষেত্রজ আলো, কখনও প্রশস্ত আলো, কখনও আলো-আঁধারির বিন্যাস। রাতের আকাশ, মহাকাশ বা পরিবেশ সঙ্কটের যে ব্যাক প্রোজেকশন দেখানো হয়েছে তাতেই নাটকের পটভূমিটি অনায়াসে পক্ষবিস্তার করে। আর বাড়ির অন্দরমহল ও রুপোগাছির সেট ডিজাইনিং চমত্‌কার কাজে আসে কাহিনির মেজাজ ধরে রাখায়। অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় মুরারি রায়চৌধুরীর চমত্‌কার সুরারোপের। যা পরিচিত গান ও তানের সুরের প্রয়োগে অপরিচিত মানুষ ও জায়গার পরিচয় গড়ে দেয়। পঞ্চানন মান্নার মেক-আপে রুপোগাছির মেয়েরা একেবারে জীবন্ত।
বাকিটুকু (যা আসলে সবটুকুও) অভিনয়। কথার মধ্যে হঠাত্‌ হঠাত্‌ ঋত্বিকের অসাড় হয়ে পড়ার যে শরীরী অভিনয় করেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য তার সত্যিই কোনও তুলনা হয় না। খুব দাগ কেটেছে রোকেয়া রায়ের সংযত, মার্জিত প্রণতি আর যত্‌পরোনাস্তি অবাক করেছে দুই তরুণী ভাস্বতী চক্রবর্তী ও রিমি সাহা যথাক্রমে অর্ণা ও ইরা। চাহনি, সংলাপ বলা ও লৌকিক উচ্চারণে বিশ্বনাথ রায়ের মনোতোষ মাস্টার এক অপূর্ব নির্মাণ।
সত্যি বলতে কী, কাকেই বা বাদ দিই উল্লেখে? এমনকী কাজের মেয়ের অভিনয়টাও মস্ত প্রাণ নাটকের। কুড়ি বাইশ জনের দলের এত সংবদ্ধ কাজে চরিত্র ধরে সবার আলোচনা সমস্যা, তাই সে চেষ্টায় গেলাম না। তবে এমন একটা সাংগঠনিক প্রয়াসের জন্য সায়ক গভীর ভাবে ধন্যবাদার্হ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.