রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সুমনামি
সুধীরলাল চক্রবর্তী চলে যান পঞ্চাশের দশকে। অকালে। তিনি ছিলেন সুরকার ও গায়ক। সেই সঙ্গে সংগীতশিক্ষক। একটি কথা মনে রাখা দরকার। গীতিকার নয়, শুধু সুরকার হিসেবে নাগরিক বাঙালি একমাত্র হিমাংশু দত্ত ও সুধীরলালের নামের সঙ্গে ‘গান’ কথাটি যোগ করে অভ্যস্ত ছিল। এতটাই বিশিষ্ট ছিলেন তাঁরা এক কালে বাঙালির মনে।
যত দূর জানি, এই বিরাট প্রতিভাধর সুরকার চল্লিশের দশকেই তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। ত্রিশ ও চল্লিশের সুরকারদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যেকেরই ধরন ছিল আলাদা। শুধু তাই নয়। এঁদের প্রতিটি সুরই যেন পৃথক সৃষ্টি। ইংরিজিতে যাকে ‘আর্ট সং’ বলা হয়, অনেকটা সেই গোত্রের। সুধীরলালের সুরে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব ছিল লক্ষণীয় রকম কম। এই দিক দিয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম ও কমল দাশগুপ্তের মতো। শচীন দেববর্মনের নাম করলাম না, কারণ তাঁর সে যুগের গানে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব না থাকলেও বাংলার পল্লিসংগীতের ভূমিকা ছিল জোরালো। সুধীরলালের সুরে পদাবলি কীর্তন হাতছানি দিলেও পল্লিসংগীতের কোনও আঙ্গিকের লেশমাত্রও ছিল না। এই দিক দিয়ে তিনি বরং বৈঠকি গানের ধারার শিল্পী। প্রধানত হারমোনিয়াম তবলা সহযোগেই তাঁর গান খোলে ভাল। বেহালা, এসরাজ, দিলরুবা, বাঁশি থাকতেই পারে। কিন্তু হাল আমলের যন্ত্রানুষঙ্গ তাঁর সুরের মেজাজে বিঘ্ন ঘটাবে।
নজরুলের পর সুধীরলালই বাংলা গানে গজলের আঙ্গিক প্রয়োগ করেছিলেন। এবং সেই প্রয়োগে তিনি নজরুলের থেকে আলাদা, যদিও দুজনেই পুরুষালি, সুরে-ছন্দে-বাঁধুনিতে কোনও ইনিয়েবিনিয়ে বলার ভাব নেই এক ফোঁটাও। নজরুলের গজল-ভাঙা গানের বৈশিষ্ট্য ছিল তালের ঝোঁক। শুনতে গিয়ে রসিক শ্রোতার হাত ঝোঁকের মাথায় একটা চাপড় মারবেই। সুধীরলালের গজল-ভাঙা গানে এই ঝোঁক-প্রবণতা নেই। তিনি থেকেছেন তালের সাবলীল ওঠা-নামায়। আরও আধুনিক। শ্যামল মিত্রর গাওয়া ‘আশা বাঁধে ঘর’ স্মরণীয় উদাহরণ। তেমনই ঠুংরি ও দাদরার রসে সিঞ্চিত আধুনিক বাংলা গানেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’, ‘কার মঞ্জীর শুনি’ চমত্‌কার নিদর্শন। মনে রাখা দরকার, কয়েক দশক আগে বেগম আখতারের কণ্ঠে আমরা ‘জোছনা করেছে আড়ি’-র মতো যে গানগুলি শুনেছি, সেগুলি বাংলা ঠুংরি। সুধীরলালের গান কিন্তু অতুলপ্রসাদের ঠুংরি ভাঙা গানের মতো বাংলা আধুনিক গান। অতুলপ্রসাদ ছিলেন আরও নরম প্রকৃতির, সুরে একটু হলেও এলানো। সুধীরলাল স্ফূর্তিবাজ, গতিশীল, চ্যালেঞ্জিং।
চল্লিশের দশক থেকেই আধুনিক বাংলা গানের সুরে অলংকাররিক্ততার চর্চা হতে থাকে। সুধীরলালের সুর কিন্তু তার বাইরে। তাঁর সুরে ছুট্তান, নানান স্বরের মিহি কারুকাজ আর মুড়কির প্রাধান্য। কিন্তু মোটা দাগে নয়, জোর খাটিয়ে নয়; সূক্ষ্ম ভাবে। হিন্দুস্থানি সংগীতের অলংকরণ তাঁর সুরভাবনার পরতে পরতে মিশে ছিল। অথচ তিনি রাগানুগত্য করেননি। একটি রাগের মেজাজে থেকেও তিনি তাতে অন্য রাগ এত মসৃণ ভাবে মিশিয়ে দিতে পারতেন, গান পেয়ে যেত নতুন মাত্রা। ‘খেলাঘর’-এর সঞ্চারীতে যে দরবারি কানাড়া এসে পড়বে, তা স্থায়ী ও প্রথম অন্তরার সুর থেকে কল্পনাও করা যায় না, কারণ সেই দুটি অংশে গান্ধার স্বরটি শুদ্ধ।
সঞ্চারীতে ‘চৈতী রাতের আকুল উছল গান
ভুলে গেলে তুমি দিলে না তা কোনও মান’
-এর ‘দিলে না’ কোমল গান্ধারে এমন দুলে ওঠে, গায়কের স্বরে কোনও বিলাপ না থাকলেও হাহাকারটা টের পাই।
ছবি: সুমন চৌধুরী।
‘তব কাঁকনের ছন্দে’, ‘ভুলেছি তোমারে অনেক বেদনা সহি’, ‘ছাইল অম্বর’, ‘ওগো মোর গানের পাখি’, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, ‘এ জীবনে মোর যতটুকু ব্যথা’ প্রতিটি গানই অলংকারসমৃদ্ধ। পরিশীলিত, সাধা গলা ও তৈরি গায়কির দাবিদার। তা ছাড়া, অনেক গানেই তাঁর অন্তরার সুর তারসপ্তকের অন্তত মধ্যম অবধি গিয়েছে। শুধু গিয়েছে নয়, মোক্ষম মোচড় বা দ্রুত তান দিয়ে গিয়েছে। ‘সেদিন বিদায়বেলায়’ (শ্যামল মিত্র) গানটির সঞ্চারীর সুর নেমে এসেছে মন্দ্রসপ্তকের পঞ্চমে আর দ্বিতীয় অন্তরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের তারসপ্তকের পঞ্চমে। অথচ গোটা কম্পোজিশন জুড়ে আড়ম্বরহীন মসৃণতা। এখানেই সুধীরলালের আধুনিকতা। তিন-সপ্তক-জোড়া বিস্তৃতির দেখনদারি নয়, সুরের আবেদনেই এ গানের পরিচিতি।
এই ব্যাপারটি একটু খোলসা করা দরকার। বাংলার বৈঠকি গানে কালোয়াতি, মায় এক ধরনের তাল-ঠোকা কালোয়াতির প্রাধান্য ছিল দীর্ঘ কাল। সুযোগ পেলেই গলাটা খেলিয়ে দেওয়া, বড় গলায় দু-একটা তান মেরে দেওয়ার এক অনাধুনিক প্রবণতা সেখানে আগেও ছিল, এখনও আছে। অনাধুনিক, কারণ গলার ওই গিটকিরি ও কাজ কম্পোজিশনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, আরোপিত। অতএব বাহুল্য। ওতে গানের গুণ খোলে না, গলার কসরত দেখিয়ে অপরিণত শ্রোতাদের কানে-গরম তারিফ পাওয়া যায়। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো জাত-শিল্পীও সত্তরের দশকে নজরুলগীতি গাইতে গিয়ে মাঝে মাঝে গলার এমন কসরত দেখিয়ে ফেলতেন যে মূল গানের মেজাজটাই যেত হারিয়ে। শুনেছি, অভিনেতা জহর রায় নাকি মন্তব্য করেছিলেন ‘পাঞ্জাবির হাতা গিলে করা এক রকম; কিন্তু গোটা পাঞ্জাবিটাই যদি গিলে করা হয়, তা হলে চলে কী করে।’ সমকালেও এমন কণ্ঠশিল্পী আছেন, যাঁরা তাঁদের গোটা পাঞ্জাবিটাই গিলে করে নেন। নামে ‘আধুনিক গান’ হলেও, পরিবেশনা হয়ে দাঁড়ায় বিরক্তিকর কণ্ঠ-কসরতের ঠান্ডা স্প্যাগেটি।
সুধীরলালের সুর সূক্ষ্ম কারুকাজে মোড়া। সেই সূক্ষ্মতা কম্পোজিশনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানেই তাঁর সুরচিন্তা ও কম্পোজিশনের নিজস্বতা। সুরকার সুধীরলালের সুররচনার এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কণ্ঠশিল্পী সুধীরলালের চোস্ত গায়কির সম্পর্ক নিবিড়। তাঁর কণ্ঠ ছিল চিকন। ছোট ছোট কাজ, ছোটবড় তান তিনি চকিতে করে ফেলতে পারতেন। এই পরিমিতিবোধ আমরা তাঁর ছাত্র, মহাগায়ক শ্যামল মিত্রর গায়কিতে পেয়েছি অনেক গানে। অতি দুরূহ, ছোট ছোট কাজ কী সূক্ষ্মতায়, কী অনায়াসে করে ফেলতেন তিনি! যাঁর সমতুল্য কণ্ঠশিল্পী, আমার মতে, আধুনিক বাংলা গানে আগেও ছিলেন না, পরেও আসেননি। অল্পবিস্তর অলংকার ও স্বরপ্রক্ষেপে চ্যালেঞ্জ-জানানো যে আধুনিক গান কোনও গায়কের কণ্ঠে শুনে প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে ‘ওরেব্বাবা, কী তৈরি গলা, কী দাপট’, সে-গায়ক রসের বিবেচনায় ব্যর্থ। তিনি ভাল ‘ক্রাফ্টস্ম্যান’ হতে পারেন, কিন্তু ‘আর্টিস্ট’ নন। ওই গানটি বা একই ধরনের গান শুনে যদি প্রথমেই মন বলে ‘আহা, কী গান’, তা হলে বুঝতে হবে, সে গানের গায়ক ‘আর্টিস্ট’, জাত-শিল্পী।
গায়ক ও সুরকার হিসেবে সুধীরলাল ছিলেন জাত-শিল্পী। সূক্ষ্ম অলংকারসমৃদ্ধ আধুনিক সুররচনায় কাজী নজরুল ইসলাম ও হিমাংশু দত্তর পর তিনিই শেষ সম্রাট।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.