রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
অপমানাব্দ
টো ড্রাইভার স্টার্ট দেওয়ার আগে ধমক মারে, দুজন খুচরো দেবেন! কোন সে দণ্ডিত দুজন, কেউ জানে না। হাতের গুটলিতে কয়েন ও বুকের গুটলিতে হৃদয় দরদর ঘামতে থাকে। বেচাল দেখলে কলার ধরে হয়তো ঠাটিয়ে ঝাড়বে। রাত এগারোটা বাজতেই তিনটে সাইলেন্সার-খোলা বাইক অবাস্তব গাঁকগাঁকিয়ে পাড়াটাকে বার বার চক্কর লাগায়, সক্কলের পিলে চমকে ঘুম চটকে ধর্ষকামী প্লেজার লিচ্চয় অর্গ্যাজ্মের বাবা। কালীপুজোর ননস্টপ দড়ামদড়াম ধারাবাহিক থাপ্পড় লাগায় সুস্থ রুচির গালে। খুব জোরে আওয়াজ করে আনন্দ পাওয়ার মধ্যে এমনিতেই প্রচণ্ড ইতরোমো আছে। পাড়ার প্রতিরোধহীন হাবা ছেলেকে ঢিলিয়ে খ্যা-খ্যা আমোদ টাইপ। সেটা উত্‌সবের ফর্মে ধর্মের বিটনুন ছড়িয়ে অন্যের বেহ্মতালুতে ছুড়তে পারলে, ওয়াঃ। ট্যাক্সিচালকরা এট্টু অন্য ভাবে শাস্তি দিচ্ছে আজকাল। মহিলা পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা দিতে নারাজ। চিপ্পুস, মিটারে যাবে। তখন মহিলা গাড়িতে ওঠামাত্র, আত্মীয়রা পা রাখার আগেই, বোঁওও। চল্ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য সেক্সের কোনও ইয়ে না, ছি, এমনি সেডিস্ট আলপিন। রাজনৈতিক দলগুলো সকালে উঠে গন্ধহাই তুলে ভাবে, গা ম্যাজম্যাজ কচ্ছে, আজ বরং জনগণের সফ্ট পাছায় একটু লাথানো যাক। ওরে কে আছিস, চৌমাথা-ফাথা দেখে স্টেজ বাঁধ, গোটা শহরের জিনা হারাম করে দিই। কী নিয়ে পোতিবাদ? সে একটা খাড়া কর না খবরকাগজ খুঁটে, আসলি কথা, সব শালা হিসি চেপে দেড় ঘণ্টা সিটে স্ট্যাচু। যদি সাধারণ মানুষকে গুছিয়ে হ্যারাস না করলাম, ক্ষমতার ক্ষীর চাটলুম ক্যামনে?
এ দিকে আমেরিকা যাকে-তাকে ন্যাংটো করে সার্চ করছে। যাকে-তাকে নয় অবশ্য, এশীয় বা কৃষ্ণাঙ্গ দেখলে দবদবা বাড়ে। সে রকম কুষ্টিকালো পেলে শুধু উলঙ্গ করে মুখ যৌনাঙ্গ পায়ু ত্রিগর্ত মজাসে হাতড়ে ক্ষান্ত দেয় না, অর্ডার দিয়ে পায়খানাও করায়। লিভারে লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ড্রাগ সেঁটে নিয়ে যাচ্ছ কি না ক্যায়সে জানব? তার পর আমেরিকা ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে নেয় তোমার তাবত্‌ মেল মেসেজ সেন্ডাসেন্ডি, প্রেমপত্র কামপত্র পদ্যখসড়া সদ্যক্রোধ। ওদের নিরাপত্তার জন্য তব টোট্টাল উন্মোচনটা জরুরি বাওয়া। সেই আমেরিকা যেতে আমাদের লাল গড়িয়ে গঙ্গা। অবশ্য এ সব একটু দূরের, প্লেনবাচক, রোজ ফুটপাতে ন’দশটা লোচ্চা যখন রকে শোওয়া পাগলিটাকে খোলা ব্যাগের মতো হাঁটকায় তখন মেয়েছেলেটার চিক্কুরে ঘুমের বড় ডিসটার্ব ঘটে, পাশবালিশ কানে ঠাসো। তাতেই কি কানের ডিফেক্ট হল, ফোন করতে করতে রেললাইনে হাঁটার কালে হরেন শুনতেই পেলুম না, অবশ্য তাতে কী, ট্রেন চাপা পড়ে প্রথমেই সেল্ফি পাঠিয়ে দিছি, মরলাম :-(
মোবাইল হাতে না থাকলে হাঁপানি হয়। হিসি করতে করতেও পাবলিক টানা ফোনে কথা বলে। গাড়ি চালাতে চালাতে মেসেজ করে। তার পর কান্নিক খেয়ে ধাক্কা মারে। তার পর খিস্তি মারে। পেট্রোল পাম্পে বাইক লাইন ভেঙে আগে তেল নিতে ঢুকে যায়। কিছু বলতে গেলে খ্যাঁকায়, ‘আপনাদের মুখে না, সেঁটে দেওয়া উচিত!’ সঙ্গে হাতের অশ্লীল ভঙ্গি। ওগুলো রপ্ত আছে। স্মার্টনেস। খিস্তির হেভি বাজার। সে হয় সকল যুক্তির বাবা। পথেও হাগব, শেষ পাতে খিস্তি দিয়ে বেরিয়ে যাব। ফিল্মেও অবশ্য, দমদার জমাটি ডায়ালগ কিছুতে হাতে আসছে না? পাঁড় খিস্তি লিখে দাও। ব্যস, মডার্ন। আর ফুটনোটে যদি স্লাইট সায়েবনাম-ড্রপাডপি আঁট-পণ্ডিতি, দেখতে হবে না, পোস্টমডার্ন (বাংলা আধসেদ্ধ প্রফেটগিরি মিশে: পোস্তমডার্ন)! সিনেমা এখন ঝিংকু ফিল্ড। স্ক্রিপ্ট নয়, পরিচালনা নয়, অ্যাক্টিং তো নয়ই, আগে বাজেট নিয়ে বোম ফাটাও। কীরম ছবি করেছ? অ্যাত্তো কোটির। পথের পাঁচালী নিয়ে আগে মুখ্যুরা কত রকম তক্কো করেছে। এ ইন্দিরের কথা বলে, ও সত্যজিতের। আরে মাল, বাজেট বল্, ওটাই আসল। পাঁচ বচ্ছর ধরে বোড়াল যেতে ট্যাক্সিভাড়া মোট কত? অবশ্য আরও আছে। রিলিজের এক সপ্তা আগে অন্য এখন-পরিচালকদের এন্তার গালাগাল দিয়ে ইন্টারভিউ বাগাও। পরের সপ্তায় ওরা আবার প্রতি-গালাগাল দেবে। এই হুপুইয়ে যদি ছবি চলে। নইলে তো ঘিলু টগবগাতে হবে, ওর চেয়ে খিস্তি-মার্কেটিং ইজি।
চারদিকে উদ্দাম উত্‌সব। পার্ক স্ট্রিটে আলো তো এক্সট্রা ক’দিন থাকলই, এসি গাড়ির কাচ ইট্টুনি নামিয়ে কে বাতাসে ছেড়ে দিল সস-মণ্ডিত রোল-কাগজ, তা ভেসেভুসে একাচোরা ভাবনার মুখে ছপ্পাত্‌। সঙ্গে সঙ্গে তূরী, ভেরী, তালিয়াঁ, গেধো সিরিয়ালের কাঁইকাঁই কান্না, চুটকি প্রতিভার দেঁতো হর্রা, শেতলাপুজোর ছ’তলা স্পিকার, পিকনিক-পার্টির ডাঁইডেসিবেল মাইক, অটোর বউ বকবকিনি এফ-এম, তা ছাড়া আমাদের ট্যাক্সিওলা মিনিবাসওলা প্রাইভেটওলা, সব্বাই হর্ন বাজাতে বড্ড ভালবাসে। হয়তো শৈশবে খুব গিটার বাজানোর শখ ছিল, বা পাখোয়াজ। হয়ে ওঠেনি, তাই এখন হর্ন। বাদ্যি আছে, মিষ্টিমুখ নেই? কন্ডাক্টর খুচরোর বদলে লজেন্স ঠুসে দেয়। আপত্তি করলে গোঁফে টুইস্ট মেরে, গাড়ি কিনে নেবেন! বেশি দরাদরি করলে ফুটপাতের হকার মুচকি হেসে নেত্র ঘুরিয়ে কার্নিশ দ্যাখে। ট্যঁাক-মুরোদ নেই তো ফোটো শালা, কথা বলার অধিকার কোত্থেকে? ব্যাংক এসএমএস-এ কী সব লিখে পাঠায়। টাকা কেটে নিয়েছে। জিজ্ঞেস করতে গেলে চকচকে মেয়ে ইংরিজিতে খুব তড়বড়িয়ে বহু প্যারাগ্রাফ বলে। তক্কো করার প্রশ্নই ওঠে না। ভার্ব খুঁজে পেতেই দিন কেটে যাবে। বাংলার রাজধানীর বুকে আমার বাংলা বলারও অধিকার আছে, মনে পড়তে পড়তে দু’স্টপ পেরিয়ে যায়।
ছোটলোকদের হাতে পুরো পৃথিবীটা চলে যাওয়ার আগে, ভদ্রতার কিঞ্চিত্‌ সম্মান ছিল। হজমোলা সাইজের, কিন্তু ছিল। ভদ্রতা একটা ত্রুটি, দুর্বলতা, লোকের মুখের ওপর ফটাং করে চিল্লে উঠে গালিয়ে দিতে না-পারাটা হদ্দ অক্ষমতা, এই ডিকশনারি কেউ জানত না। এখন ভদ্রকে ভাবা হয় মিনমিনে, মেনিমুখো। মেরুদণ্ড নেই। তাই ভদ্র। ধক থাকলে, কেড়ে খেত। বাইসেপওলা ছেলে প্রচণ্ড জোর ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, ‘সরি’ বলার এফর্টটুকু খরচা করে না। মেট্রোয় উঠে ইয়াং গ্রুপ সবাইকে বিষগুঁতিয়ে ট্রেনের ল্যাজা টু মুড়ো জগিং সেরে নেয়। পথেঘাটে ফাঁটুবাবু মুখ থেকে ফচাত্‌ গুটখা ছুড়ে শার্ট রাঙিয়ে কটমটিয়ে চেয়ে থাকে: আ বে ল্যাংড়া নাকি? ডজ করতে পারলি না? আইন মেনে দাঁড়-খাওয়া লোক পেছন থেকে প্যাঁক পায়, ‘দাঁড়িয়ে থাকলে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে! সিগনাল শোওয়ার ঘরে মানবেন!’ সব্বাই ঠেলছে, হামলাচ্ছে, দৌড়ে এ-ফুটে এসে পা মাড়িয়ে দিয়ে ও-ফুটে ফিরে যাচ্ছে। বগলের তলা দিয়ে মুন্ডু গলিয়ে বলছে, আমার টিকিটটা আগে। ডাঁয়েবাঁয়ে আঘাত করতে মুখিয়ে আছে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে বন্ধু দু’কথার মধ্যে তাকে দুর্দান্ত ডাউন দিয়ে সমবেত গ্রুপে খিল্লি তুলছে। পাঠক ফোন নম্বর জোগাড় করে লেখককে খোঁচাচ্ছে, ‘হ্যালোওও, আপনার ভাষা নোংরা!’ গণধর্ষিতার বাড়িউলি বারবার বোঝাচ্ছে, রেপ্ড হওয়া করে এসেছে জানলে ভাড়া দিতাম? সিরিয়াসতা দেখলেই নিরক্ষর গ্যাঁড়া রোঁয়া ফুলিয়ে মধ্যাঙুল ঝলসাচ্ছে, ‘বোর কোরো না মামা, ইনস্ট্যান্ট চুলবুল চাহিয়ে!’ জীবন-নিপুণ মানুষের সংজ্ঞা: উদ্ধত, রেলাবান, নখ-বাগুয়া। তেড়ে, রসিয়ে, অপমান সাঁটিয়ে দাও। নীতির চেয়ে লাথি বেশি এফেক্টিভ, মান্তু।
এইগুলো আয়ত্ত করার মূল সূত্র: আত্মশাসন হাটাও। নিজেকে কদাপি ওজন, বিচার কোরো না। এই তত্ত্বেরই প্রচার এখন হু-হা। আগে বাঙালি টিভিতে গিয়ে শক্ত তত্‌সম বলত। এখন রিয়েলিটি শো-তে লাউ-কাটাকাটি কনটেস্ট জিতে ভাসান-ডান্স নাচে। এই অস্তিশিথিল যুগ বলে, ভেবো না, ভেবো না, অ-ভাবা প্র্যাকটিস করো। বিন্দাস হ ইয়ার। গিঁট্টু খুলে দে। হিসি পেলে, ছরছরিয়ে কর। তাই বিখ্যাত ফুটবলার বাঁধাকপির ফলন নিয়ে অনায়াসে বাইট দেয়। তাই হিট-পরিচালক দাপায়, বেশ করেছি টুকেছি, বেওসার কোয়ান্টিটি দ্যাখ! তাই পার্ক স্ট্রিটের হুল্লোড়ে বর্ষশেষের কনুই মারতে লোফাররা লাফিয়ে পড়ে। তাই ভবানীপুরের কাছে এক দারোয়ান কুকুরকে রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ভরবিকেলে খুন করে, ঘেউঘেউতে ঘুম হচ্ছিল না। তাই ভারতবিখ্যাত গায়ক দেশের এক সেরা ক্যাম্পাসে ফাংশন করতে গিয়ে বলে, মেয়েদের আছে রূপ আর ছেলেদের আছে বুদ্ধি, নিশ্চয়ই তোমরা একমত যে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান! তাই সিরিয়ালে ছাতা-মাথা কী আছে দেখার আগেই হুমকি বাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, কারণ সেটা যে লিখেছে তার মুখটাই মারকুটে গোষ্ঠীর অপছন্দ। তাই ধর্মনেতা সমকামীদের গাল দেয়: অসুখওলা। তাই এক রাজ্যে মুখ্যপান্ডারা হুপ্পু-মোচ্ছব মানায় আর ক্যাম্পে দাঙ্গাধ্বস্ত মানুষ শীতে থুবড়ে মরে। তাই এক রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ডিতদের জেল-কুঠুরি থেকে মৃত্যুকক্ষে ঢোকা লাইভ টেলিকাস্ট করে সরকারি চ্যানেলে। তাই পলিটিশিয়ান বুক বাজিয়ে খাপ পঞ্চায়েতের গণখুন সাপোর্ট করে। তাই পাবলিক সুড়ুক চা টেনে বলে, ও মার্ডার করিয়েছে তো কী, এফিশিয়েন্ট তো! প্রাইম মিনিস্টারের তা-ই হওয়া দরকার! তাই যে লোক শিক্ষিত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, শিক্ষা যে-সব দস্তুর আরোপ করে তার অর্জন-রেওয়াজ চালাচ্ছে, হৃদয় ও করতলকে নরমতর করার সাধনা অভ্যাসাচ্ছে, সে ঘুম থেকে উঠেই থাবড়া খায়।
নতুন বছর, সব্বার ধুকপুক কুসুম-কুসুম ইতিবাচকতায় নাইছে। সব ভাল হবে। সচিন গেছে তো কী হয়েছে, কোহলি এসেছে। মধ্যমগ্রাম মিইয়ে যাবে, বিশ্বকাপ বমবমাবে। এই বছরে হয়ে উঠতে হবে অপমানকারী, অপমানিত আর নয়। নইলে সারভাইভ করা যাবে না, অন্তে ডোডোবাজি ফলিয়ে মিউজিয়ামে মিউমিউ। তাই রেজোলিউশন: ‘রাইড দ্য কাউবয়, নট দ্য হর্স’ লেখা টি-শার্ট আর ঠেঙো হাফপ্যান্ট পরে মল-এ যাব, এসকালেটরের সামনে থতমত বুড়িকে লাউড বিরক্তি-প্লিচ মারব, লাইনের উলটো দিক দিয়ে প্যাক্ড পেঁপে এগিয়ে, আপত্তি-করা গরিব-গরিব কেল্টে দেখতে কাউন্টারের ছেলেটাকে ডেঁট্টে তোড় করব। ‘এফ’-শব্দ দিয়ে শুরু। আমার তো সেটিং হয়ে গেল, আপনার?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.