‘সময় নেই’ অজুহাত দেবেন না
য়েক দিন আগে মধুপুর বলে খুব সুন্দর একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
মধ্যমগ্রাম চৌরাস্তা থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে একটা নিরিবিলি জায়গা। সেখানে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার একটা কেন্দ্র খোলা হয়েছে বাচোয়াত ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। এমন একটা জায়গা যেখানে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-ইতিহাসবিদ-শিল্পরসিক, সমালোচক সকলেই জমায়েত হয়ে অনাবিল আড্ডা দিতে পারেন। আর্ট ক্যাম্পস আছে, মৃৎশিল্পীদের কাজ করার জায়গা আছে। আছে অতিথিদের থাকার জায়গা। আলোচনা ও বিতর্কের আসর বসানোর জায়গাও আছে।
সব দেখেশুনে দুটো ব্যাপার আমার খুব নজর কাড়ল। প্রথমত বার-এর দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা একটা কথা, ‘নো ওয়াই ফাই। টক টু ইচ আদার। অ্যান্ড গেট ড্রাঙ্ক।!’ যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘ওয়াই ফাই নয়। পরস্পর কথা বলুন। আর মাতাল হয়ে যান।’ ভাল লেগেছিল গানবাজনার আসর দেখেও। লোকজন জড়ো হয়ে মেতেছিল বাউল গানের সঙ্গে আপন খেয়ালের নাচে। শিল্পীরা বসে অসাধারণ সব ছবি আঁকছিলেন। সকলে যখন আড্ডা আর আলোচনায় ব্যস্ত, তখন একবারও তড়িঘড়ি সেলফোন বেজে ওঠেনি। শোনা যায়নি কোনও রিংটোন।
ল্যাপটপ নিয়ে নিজের মনে বসে থাকার এই জমানায় কারও সঙ্গে বসে কথা বলা কিংবা না জানিয়ে কারও বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসা এ সব প্রায় উঠেই গিয়েছে।
শিক্ষাজগতে কাজ করেন এমন এক ব্যস্ত মহিলার সঙ্গে সম্প্রতি আমার আলাপ হল। তাঁর স্বামীও কর্পোরেট কর্মী। ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ে। শুনলাম ওঁরা পরবিবারের সবাই বাড়িতে রাতে সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করার ফাঁকে সারা দিনে কী হল না হল, তা নিয়ে কথা বলেন। গল্প করেন। সেই সময় ফোন থাকে সায়লেন্ট মোডে।
সে দিন বিয়েবাড়িতে গিয়ে আর এক মহিলাকে দেখলাম। তিনি তাঁর তিন বন্ধুর সঙ্গে কবে দেখা করবেন তাই নিয়েই জল্পনায় মশগুল। জানলাম ওঁদের এই দেখা করাটা প্রায় সাপ্তাহিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে। সপ্তাহান্তে একবার অন্তত ওঁরা দেখা করে আড্ডা মারেন, গল্প করেন, পরনিন্দা-পরচর্চাও হয়। আবার কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে তা নিয়েও আলোচনা হয়। অসুস্থ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও দেখা করতে যান নিয়মিত। এমনকী বাড়ির বয়স্ক গুরুজনদের সঙ্গেও নিয়মিত দেখা করতে যান। ঠিক যে ভাবে অফিস-কাছারিতে কাজের ডেডলাইন বজায় রাখি, ঠিক সেই ভাবে এই ব্যস্ত জীবনে কোনও না কোনও ভাবে সময় বের করে অন্তত কিছু কিছু সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্ল্যানিং আমাদের করতেই হবে।

অল্পবয়েসিদের কথায় আসি। আজকাল ওদের মধ্যে একটা অভ্যেস খুব নজরে পড়ে। যখনই একদল ছেলেমেয়ে গল্প করতে বসে, পাশের বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার বদলে দেখা যায় তারা সেলফোনে মগ্ন। তাদের কি মনে হয় বিবিএম করে, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক করে বাইরের সকলের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে ইন্সট্যান্ট যোগাযোগ রাখাটা খুব জরুরি? আড্ডা চলাকালীন সেলফোন যে একেবারে বহিরাগত, অবাঞ্ছিত সেটা সচেতন ভাবেই ওদের মনে করিয়ে দিতে চাই।
অন্য শহরে থাকা দাদু-দিদা, ঠাকুমা-দিদিমার সঙ্গে আজকালকার ছেলেমেয়েদের স্কাইপে কথা হয়। বলতে পারেন, হাল আমলে কবে কোন নাতিনাতনি শেষ তার দাদু-দিদাকে খুব ভালবেসে চিঠি লিখেছে? আমার মা যখন মারা গেলেন, যাঁরা আমাকে চিঠি লিখেছিলেন তাঁদের সব চিঠি রেখে দিয়েছি। যাঁরা আমায় সেই বেদনার সময় চিঠি লিখেছিলেন, আমার জীবনে তাঁদের অপরিসীম গুরুত্ব।
অনেক সময় গাড়িতে করে কারও সঙ্গে হয়তো যাচ্ছি। দেখলাম তিনি আমার সঙ্গে কথা না বলে হয় মেল চেক করছেন, না হলে মেসেজের উত্তর দিচ্ছেন। এই ধরনের ব্যবহারে সৌজন্যবোধের খুব অভাব। যদি একান্ত জরুরি কোনও খবর দেওয়ার থাকে, তা হলে পাশের মানুষটাকে ভদ্রতাসুলভ জিজ্ঞেস করা উচিত তিনি কি একটা ফোন করতে পারেন বা মেসেজ পাঠাতে পারেন? তবে এই পরিস্থিতিতে ফোন বা মেসেজ দ্রুত সেরে ফেলাই ভাল। ইদানীং একটা ব্যাপার খুব ভাল হয়েছে। স্কুল-কলেজ-অফিস রিইউনিয়নের চল। অনেক সময় দেখেছি এই সব রিইউনিয়নে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়। রিইউনিয়নে দেখা হওয়ার পর অনেকে পুরনো বন্ধুদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনে তাঁদের চিকিৎসাগত ভাবে বা মানসিক সমস্যায় সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেন। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যেতে হলেই বা কেন এত আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েটানিয়ে যেতে হবে? কেনই বা আড্ডার আসর বসবে সাজানো মঞ্চে? তবু এরই মধ্যে বহু মহিলাকেই দেখি দেরিতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে, শরীর না বইলেও সামাজিক সম্পর্ক, আত্মীয়তাগুলো বজায় রাখার কী সাঙ্ঘাতিক চেষ্টা করে চলেন! আমি তাঁদের বলব, তাঁরা যা করছেন তাকে ‘পজিটিভ’ ভাবে দেখা উচিত। তাঁরা যেন এটা উপলব্ধি করেন পরিবারের বন্ধনটা সুদৃঢ় হলে আবেগের জায়গাগুলোও শক্তিশালী হয়। পেশাগত সম্পর্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একান্ত পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো। শুধু মহিলারাই নয়, বাড়ির পুরুষদেরও উচিত স্ত্রীদের পাশে থেকে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখায় শামিল হওয়া।
এসো কথা বলি
• সেলফোনে নিজের ছবি না তুলে চেষ্টা করুন অসুস্থ কোনও আত্মীয়কে দেখে আসতে
• পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হলে কাজের জায়গার সমস্যা কাটিয়ে ওঠার মনের জোরটাও পাওয়া যায়
• আড্ডা মারার সময় বিবিএম বা হোয়াটস্অ্যাপ এক্কেবারে নয়
• চিঠি লিখুন। এতে মানসিক আদানপ্রদান আরও গভীর হবে
• রাতে ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে খাবার অভ্যেসটা বজায় রাখুন
• আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিত সরাসরি যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রী ভাগ করে নিন। ঠিকই সময় পেয়ে যাবেন
সেলফোনে যখন তখন নিজের ছবি তোলা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সেলফি’ খুব আত্মকেন্দ্রিক একটা ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তে ছবিটবি পোস্ট না করে সেই সময়টা ব্যবহার করে তো কোনও অসুস্থ আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। কিংবা অনেক দিন দেখা হয়নি এমন কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায় না কি?
এমনকী মর্নিং ওয়াকে যাঁদের সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটেন, ঘুরিয়েফিরিয়ে মাঝে মাঝে তাঁদের বাড়িতে খেতে ডেকে, আড্ডা দিয়ে অন্তরঙ্গ হতে পারেন। এই সব আড্ডায় খেলাধুলোরও আয়োজন হয়। ক্যুইজের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে পুরস্কার জিতে আনন্দ করতে করতে বাড়ি যেতে পারেন! আড্ডায় বসে রান্নার রেসিপি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। বাড়ি ফিরে মুখরোচক রান্না করে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন মেয়েরা। আড্ডার গ্রুপ ছবি তুলে পরস্পরকে মেল করলে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে।
‘আমার তো সময় নেই’ এই অজুহাত দেবেন না। ব্যস্ত জীবনের জটিল জিগ্-স-পাজলের মধ্যেই প্রস্থে প্রস্থে সময় বের করতে হবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, কথাবার্তা বলার জন্য। পুরুষেরা অনেক সময়ই পরিবারের বহু সামাজিকতা, লৌকিকতার দায় স্ত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেন। এটাই বা কেন হবে? নাকি আমরা এমন এক অসাম্যের সমাজে বাস করি এখনও, যেখানে মেয়েদের দশভুজা হয়ে চতুর্দিক সামলাতে হবে, আর পুরুষেরা একই ভাবে আয়েস করে যাবেন! যেমনটা চিরাচরিত ভাবে হয়ে আসছে?
ব্যস্ততার এই সময়ে তাই নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিন।
ছেলেমেয়েদের বলুন তারাও যেন আপনার পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।
মনে রাখবেন এটাই কিন্তু আসল সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং।
ইন্টারনেটে যেটা কখনওই সম্ভব নয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.