জুহুর ধারের পার্টিগুলো
য়েক দশক আগের ঘটনা।
মুম্বইয়ের এক পার্টিতে রাজ কপূর আমন্ত্রিত।
বলিউডের অরিজিনাল শো-ম্যান নাকি আমন্ত্রণের সময় প্রশ্ন করেছিলেন নিজের প্রিয় ব্র্যান্ডের স্কচ-টা নিয়ে আসতে পারবেন কি না। উনি ওই ব্র্যান্ডের স্কচ-টা বেশি পছন্দ করতেন বলে এমন একটা অদ্ভুত অনুরোধ। পার্টিতে এলেই এক কোনায় চলে যেতেন, আর সব সেলিব্রিটিই তখন ওই কোনায় ভিড় জমাতেন। একটা অলিখিত নিয়মও ছিল সেই সময়ের পার্টির। যে অভিনেতার ছবি হিট, তিনি ট্রান্সপ্যারেন্ট শার্ট আর সাদা জুতো পরেই পার্টিতে আসবেন।
কাট বলে সোজা চলে আসুন ২০১৩-তে। পার্টির মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছে বইকী। বলিউডে অবশ্য পার্টি করার জন্য তিনটে বিশেষ সময় বরাদ্দ থাকে। দিওয়ালি, হোলি আর ইফতার। তবে তাই বলে তো আর এটা বলা যায় না যে অন্য সময় তারকারা পার্টি করেন না! এই তো শনিবার দীপিকা পাড়ুকোন এক পার্টি দিয়েছিলেন।
কিন্তু সে পার্টিতে তারকারা আর সাদা জুতো পরে ঢোকেননি। নিজেদের পছন্দের স্কচটাও হয়তো আর বয়ে আনেননি। এখনকার পার্টির অন্দরমহলের গল্পগুলো তাই অন্য রকমের।
পার্টি হওয়ার ঠিক দু’তিন দিন আগে মুম্বইয়ের ট্যাবলয়েড বা এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলে ‘খবর’ হিসেবে ছাপা হয় গেস্ট লিস্ট। বলে দেওয়া হয় কাদের ডাকা হল, কারাই বা বাদ পড়লেন সেই তালিকা থেকে!
এটাই প্রথম পাতায় বড় করে খবর আকারে বেরোয়। কর্ণ জোহরের জন্মদিনে কে আমন্ত্রিত, সে খবর আজকাল বান্দ্রা থেকে বাঁকুড়ার সবার মুখে ঘোরাফেরা করে। কাউকে কেন বাদ দেওয়া হল, সেটাও ফলাও করে লেখা হয়।
আর এটাই নাকি পার্টির পালাবদলের সব থেকে বড় চমক। “আগেকার দিনে পার্টি মানে ছিল এর সঙ্গে ওর দেখাসাক্ষাৎ হওয়া। সবাই মিলে আনন্দ করব এটাই ছিল মূল মন্ত্র। কত বিচিত্র সব ঘটনা ঘটত! মনে আছে দেব আনন্দ এক পার্টিতে গিয়েছিলেন জিনাত আমনকে নিয়ে। ইচ্ছে ছিল সে রাতেই নিজের মনের কথা জানিয়ে দেবেন জিনাতকে। বাদ সাধলেন রাজ কপূর। মদ্যপ অবস্থায় জিনাতকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই ঘনিষ্ঠতা দেখে দেব আনন্দ নাকি বিমর্ষতায় ডুবে যান। ভাব ভালবাসা থেকে মারপিট, সবই হত পার্টিতে,” বলছেন বলিউডের এক সেলিব্রিটি।

তবে পার্টির সেই মুড এখন পাল্টে গিয়েছে, বলছেন তিনি। “এখন তো এগুলো মিডিয়া ইভেন্ট হয়ে গিয়েছে। সবাই নাকি আজকাল ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের’ সঙ্গে পার্টি করেন। জাহির করার চেষ্টা করেন কে কার ‘লোক’। আগে মানুষ এটা করতে ভয় পেত, লজ্জা পেত। এখন ও সব নেই। ওপেনলি নিজেদের স্ট্রেংথ দেখানোটাই হল পার্টির উদ্দেশ্য,” বলছেন সেই সেলিব্রিটি।
অভিনেত্রী অঞ্জু মহেন্দ্রু এক সময় প্রচুর পার্টি করতেন। নিজেও অনেক পার্টি হোস্ট করতেন তিনি। তবে তাঁর বাড়ির পার্টি মানেই ছিল লনে একটা বনফায়ার, সুন্দর বারবিকিউ আর গান। “সে যুগে ডিজে ছিল না। আমি চাইতাম সবাই খোলা গলায় গান গেয়ে আনন্দ করুক। হিন্দি সিনেমার গান। হয়তো রাজস্থানি কোনও গায়িকাকে ডেকে নিলাম। ওই ‘পল্লু লটকে’র মতো গান গাইল। এসো, বসো, রিল্যাক্স করো এটাই ছিল আইডিয়া।” বলছেন অঞ্জু।
এই নয় যে ছ’ইঞ্চি হিল পরে ঢোকো, প্রচুর মেক আপ করে বসে থাকো। “আমাদের নিউ ইয়ার ব্যাশ মানে আড্ডা। আর এখন? শুনেছি নতুন নতুন অভিনেতারা নাকি জামাকাপড় থেকে জুয়েলারি সব কিছুই ধার করে পার্টিতে পরে আসেন। আমাদের সময় তো এটা করার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। সম্মানে লাগবে যে!” বলছেন অঞ্জু।
কথা বলতে বলতে অঞ্জু জানান তখনকার দিনে পার্টিতে প্রেস ঢুকতে পারত না। “এখন তো সব প্রফেশনাল। প্রেস-এ পার্টির ছবি পৌঁছে যায়। এই ছবিগুলো ওই সেলিব্রিটিরা নিজেরাই নিশ্চয়ই লিক করেন। না হলে মিডিয়া তা পাবে কী করে?” প্রশ্ন অঞ্জুর।
আজকাল মার্কেটিং-য়ের যুগ। এমনটাও শোনা যায় যে, সেলিব্রটি ডিজাইনারের কাছ থেকে গয়না ধার নিয়ে পরলেন, কিন্তু পয়সা দিলেন না। “কোথাও একটা কমেন্টে ডিজাইনার বা ব্র্যান্ডের নাম বলে দিল। তাতেই খদ্দের জুটে যায়। সব কিছুই এখন ডিল করেই হয়। আমাদের জমানায় তা ছিল না। তিনটে পার্টিতে যদি এক পোশাক পরে আমাকে দেখা যেত, তাতেই বা ক্ষতি কী? কিন্তু এখন এই সব নিয়ে তারকাদের দেখি অনেক মাথাব্যথা,” বলছেন অঞ্জু।
তবে সে ছিল অন্য এক যুগ! রাজ কপূর তাঁর চেম্বুরের কটেজে এমন পার্টি দিতেন, যার গল্প এখনও লোকের মুখে মুখে ঘোরে। স্কচ আর কাবাব থাকত মেনুতে। আর হোলির পার্টির মজাই ছিল ভাং খেয়ে সিতারা দেবীর ঠুমকা দেখা। মিডিয়া থেকে এক-দু’জন ছাড়া কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। আর যাঁরা ঢুকতেন, তাঁদের সাফ বলে দেওয়া হত যে পার্টি মানে আনন্দ। সেখানে কলম বা ক্যামেরা চলবে না।

তবে সুভাষ ঘাইয়ের পার্টিতে কিন্তু প্রেস-য়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হত না। “দারুণ খাওয়াদাওয়া আর ভাল মিউজিক তো থাকবেই। সুভাষজি এমন পার্টি দিয়ে থাকেন, যেখানে উনি নিজে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেন। এমনকী নিজের অফিসের স্টাফকেও উনি ফোন করে আসতে অনুরোধ জানান। এই আন্তরিকতাটা অন্যদের মধ্যে দেখি না। নিজে সারাক্ষণ পার্টিতে থাকেন, আর প্রয়োজনে ডান্স ফ্লোরেও তাঁকে দেখা যায়,” বলছেন সুভাষ ঘাইয়ের অফিসের এক স্টাফ।
দু’বছর আগে গীতিকার প্রসূন যোশীর বাড়িতে নিউ ইয়ারের পার্টি হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমির খান। আর সে পার্টির সব চেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল উস্তাদ রাশিদ খানের প্রোগ্রাম।
তবে প্রেসের অবাধ প্রবেশের জন্য কিছু তারকা এখন বেশ সতর্ক হয়েই পার্টি করেন। যত ইচ্ছে মদ খাও, যত ইচ্ছে সিগারেট ধরাও এটা সব সময় মিডিয়ার সামনে করলে যদি তারা পরের দিন হেডলাইন হয়ে যান? বিবিএম স্টেটাসে বা হোয়াটস্অ্যাপের ছবি শেয়ার করলেই তো সোজা সেটা নিউজরুমে পৌঁছে যাবে। সেই অস্বস্তিটা অনেকক্ষেত্রেই তাড়া করে বেড়ায়।
তবে এ সব বিড়ম্বনা এড়াতেই শুরু হয় নিউ এজ বলিউড পার্টি। যার প্রথম শর্ত হল কোনও ছাপা আমন্ত্রণপত্র পাঠানো যাবে না। এসএমএস করে যদি পার্টির ইনভিটেশন আসে, তার মানে কিন্তু সেটা ওই রেগুলার একটা আম-জনতা ইভেন্ট। যেখানে স্টার আসবেন কুড়ি মিনিটের জন্য। মিডিয়াকে কিছু বাইট দেবেন। আর তার পর কিছু না খেয়েই দৌড়!
এই সব পার্টিতে মিডিয়ার প্রচুর আনাগোনা। বলছেন বলিউডের পাবলিসিস্ট ডেল ভাগওয়াগর, “এখন তো এফেক্টের জন্যই সব কিছু করা হয়। খাবারের কোয়ালিটি কত ভাল তার থেকে বেশি জরুরি পার্টিতে কত জন এল? কোন তারকা কত সেনসেশানাল কোট দিল? লাঞ্চ, ব্রাঞ্চ বা ডিনার পার্টির থেকে বেশি সংখ্য্যায় দেখা যায় ককটেল ইভেন্টস। সেখানে সব কিছুই মেকি। আগে পার্টিতে বেশি দেখা যেত প্রিন্ট জার্নালিস্ট। এখন সেখানে টেলিভিশন আর নেট জার্নালিস্টেরই সংখ্যা বেশি। আগে আমরা সহজেই ‘গেটক্র্যাশার’দের চিহ্নিত করতে পারতাম। আজ সেটা ধরতে পারাটা একটা বিড়ম্বনা।”
তবে আসল বলিউড পার্টি মানে স্টার বা তাঁর স্ত্রী নিজে থেকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানাবেন। আর সেখানে মিডিয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ। একতা কপূর যখন পার্টি আয়োজন করেন তখন তার বিশেষত্ব হল, সেখানে তিনি নিজেই আসেন অনেক দেরি করে। “আগে টেলিভিশনের লোকজন ওর পার্টিতে যেত। এখন তো বলিউডের অনেকেই যায়। নিজের জন্মদিনের পার্টিতেও লেট করে ঢোকেন। হয়তো এলেন রাত বারোটার পরে। তারপর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ‘শটস্’ খাওয়ান,” বলছিলেন একতার পার্টিতে আমন্ত্রিত এক অতিথি।

রাজ কপূর
পার্টিতে দেব আনন্দের সঙ্গে
এলেন জিনাত। নেশার
ঘোরে তাঁকে জড়ালেন রাজ

শাহরুখ খান
তাঁর পার্টি চলে সারারাত ধরে।
শেষ যখন হয় তখন ঘড়ির
কাঁটায় সকাল সাতটা

সুভাষ ঘাই
নজিরবিহীন আন্তরিকতা।
অফিসের কর্মচারীকেও আলাদা
করে নেমন্তন্ন করেন
তবে এই পার্টির সঙ্গে ফিরোজ খানের পার্টির কোনও তুলনা হয় না। অভিনেতা ফারদিন খানের বাবা ফিরোজ খান একদম রাজার মতো জীবনযাপন করতেন। কিছু তারকাদের নিয়ে জুহু গ্যাং ছিল ওঁর। শোনা যায় যে, যখন পার্টি শেষ হত, তখন গোলাগুলির শব্দ শোনা যেত। পার্টির শেষে এতটাই মত্ত হয়ে যেতেন অনেকে যে, ভাষার ওপর আর লাগাম থাকত না। সত্তরের দশকে জুহুর পার্টিগুলোতে পাওয়া যেত ড্রাগ, ম্যানড্রাক্স আর হ্যাশ। তবে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ কথা বলতেন না।
দিলীপকুমারের ঈদের পার্টির কথা অবশ্য অন্য মেজাজের। সেই পার্টির বিরিয়ানি আর কাবাবের গল্প করেন অনেকেই। ও দিকে সেলিম খানের পার্টির যথেষ্ট চর্চা হয় ইন্ডাস্ট্রিতে। দারুণ খাওয়াদাওয়া। সেই পার্টি শেষ হতে হতে রাত হত বেশ। এ বছর দিওয়ালিতে পুত্র সোহেল খান আর তাঁর স্ত্রী মিলে একটা পার্টি দিয়েছিলেন। সেখানে সলমন খান উপস্থিত কালো রঙের গেঞ্জি পরে। দেখা গিয়েছিল শাহরুখের স্ত্রী গৌরীকেও।
দু’মাস আগে অবধি শাহরুখ আর গৌরী নিয়মিত পার্টি দিতেন। “সেই পার্টি চলত সকাল সাতটা অবধি। দারুণ খাওয়াদাওয়া। আর নাচ। আমি তো হৃতিক রোশন আর ফারহান আখতারকে ড্যান্স ফ্লোরে নাচতে নাচতে গড়াগড়ি খেতেও দেখেছি। অমিতাভ বচ্চনের পার্টি অবশ্য ভীষণ ক্লাসি। সব কিছুতেই আভিজাত্যের ছাপ। কর্ণ জোহরের পার্টিটা আরও একটু ঘরোয়া হয়। তবে সেটাও বেশ ক্লাসি থাকে,” বলছিলেন শাহরুখের পার্টির এক নিয়মিত সদস্য।
তবে সমস্যা হয় সেই সব পার্টিতে যখন তারকারা কোনও অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। বেশি রাত অবধি জোরে গান চললেই পাশের বাড়ি থেকে কেউ না কেউ অভিযোগ করে বসেন। তখন আবার উল্টো চাপ। পুলিশ এসে হাজির হয়ে যান পার্টিতেই। এমনটাও শোনা গিয়েছে যে বেগতিক দেখে তারকাদের পার্টির স্থানই পাল্টে ফেলতে হয়েছে। হৃতিক রোশনের বাড়ি পালাজ্জিও-তেই তো ২০০৯-এ পুলিশ এসে হাজির হয়েছিলেন, যখন সুজানের জন্মদিনে হৃতিক ধুমধাম করে পার্টি দিয়েছিলেন। সে যাত্রা অবশ্য বেশি ঝামেলা হয়নি।
ঝামেলা হয়, যখন পার্টিতে পার্টি ড্রাগস বিতরণ করা হয়। এ নিয়ে অবশ্য কেউ মুখ খুলতে রাজি থাকেন না। লুকিয়ে তোলা পার্টির ছবি কাগজে লিক হলেও, এ বিষয়ে সব্বার মুখে কুলুপ। ‘পার্টি আভি বাকি হ্যয়’ গানটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনই সত্যি হল পার্টির কিছু গল্প সব সময় বাকি থেকে যায়। কারণ, তা বলে ফেললে তারকাদের এনিগমাটা কমে যায়। তা ছাড়া এ হল তারকাদের পার্টির গোপন কথা।
সেটা অন্দরমহলেই রাখাটাই শ্রেয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.