আমার গুরু ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র ছিলেন আপনি। ইফি-তে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে কেমন লাগল?
আমি এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছি। এত পুরনো কথা মনে পড়ছে। পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট-এ আমি তিন বছর ওঁর ছাত্র ছিলাম। শুধু ছাত্র বললে ভুল বলা হবে। ব্লু-আইড বয় ছিলাম। খুব প্রিয় ছাত্র যাকে বলে। কত যে স্মৃতি রয়েছে ওঁকে ঘিরে। আজকে তাই সিনেমাটা দেখে মনে হল যেন ওঁকে আর এক বার চোখের সামনে দেখতে পেলাম। থিয়েটার আর সিনেমা এই দুটোর রসদ ভাল পরিমাণ রয়েছে ছবিতে।

কোন ঘটনাটা বিশেষ ভাবে আজ মনে পড়ছে?
কত ঘটনা। উনি ছাত্রদের খুব প্রিয় ছিলেন। ওঁর সিনেমার ভাষা দারুণ লাগত। আর ভাল লাগত ওর মুখে নানা রকমের গল্প শুনতে। এই রকম অনেক সময় হতযখন ওঁর সঙ্গে বসে ছাত্ররা মদ খেত। কেউ কেউ এটা পছন্দ করত না। কিন্তু আমরা তো ওটা ইচ্ছে করে করতাম। মদের টাকাটাও দিতাম। একটাই লাভ মদ খেয়ে সাঙ্ঘাতিক ইন্টারেস্টিং গল্প করতেন উনি। ভাষার কোনও লাগাম ছিল না। ‘চ’-‘ব’ ওয়ালা গালাগালিও দিতেন। কিন্তু এই কথাগুলো ওঁর মুখে শুনে অপমানিত মনে হত না। বরং বুঝতাম ভালবেসেই উনি আমাদের ও ভাবে ডাকতেন। এক বার তো মিনিস্ট্রি থেকে এক জন এসেছিলেন এফটিআইয়ে। খাওয়াদাওয়ার পর তিনি বললেন ‘একবার আপনাদের স্টুডিয়োটা.....” যেই না এ কথা বলা স্যর পত্রপাঠ তাঁর মুখের ওপর বলে বসলেন, “ ইন্সটিটিউট ঘুরে দেখার কোনও দরকার নেই। কারণ তিনি জানেনই না এফটিআই কোনও স্টুডিয়ো নয়। ওটা ফিল্ম ইন্সটিটিউট। অন্য কেউ হলে এত সরাসরি সত্যি কথা বলতেন না। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক একদম স্বতন্ত্র। অন্তর্নিহিত সত্যটা বলাই একমাত্র রাস্তা ছিল তাঁর কাছে। ওই যে অভিনেতা ঘটকের রোলে অভিনয় করেছে, তার অভিনয় আমার বেশ লেগেছে।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়?
ওই যে চোখের মণিটা এ ভাবে ও ভাবে নাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, ওটা তো উনি করেন। সব সময় দু’ সাইজ বড় পাঞ্জাবি পরেন।

আপনি প্রেজেন্ট টেন্সে কথা বলছেন ওঁকে নিয়ে...
হুম....সিনেমাটা ওকে প্রেজেন্ট টেন্সেই এনে দিয়েছে আমার কাছে।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির দৃশ্য।
আপনি ঋত্বিক ঘটকের জন্য একবার মাথা ন্যাড়া করেছিলেন?
হ্যা। একদিন আমাকে বললেন, “যাও। যাকে বাল কাটাকে আও।’ ভিক্ষুকের রোল। বললেন, “রেজর চালিয়ে মাথাটা কামিয়ে এসো।’’ এ দিকে আমার তো একদমই ইচ্ছে নেই। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম আমাকে ছেড়ে দিতে। অন্য কাউকে বললেই মাথা ন্যাড়া করে ফেলবে। কিন্তু উনি বলছিলেন, “এখন রাগ করছো, ছবিটা বেরোলে এটাও এমন একটা ছবি হবে, যেটা তোমার কাছে গর্বের হবে। আরও একটা মেজর ঘটনা হয়েছিল তখন।

সেটা কী?
জানি না। কী ভাবে উনি জেনেছিলেন। তবে নিশ্চিত ছিলেন যে ন্যাড়া হলে আমার মাথাটা একদম গোল দেখতে লাগবে। আমি নিজেও জানতাম না। তাই শ্যুটিংয়ের দিন আয়নায় নিজেকে দেখে আমি তো অবাক। সত্যি তো আমার মাথাটা কামালে একদম গোল লাগে। ওই ছবিটা পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের আর্কাইভে রাখা আছে। নাম ‘বসুদত্ত।’ আজ কিন্তু এই সিনেমাটা আমার কাছে খুব স্পেশাল।

আপনি তো ‘নৌকাডুবি’ ডাব করে হিন্দিতে বানিয়েছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কি হিন্দি বানানোর ইচ্ছে আছে?
আমি চাইব প্রথমে একটা ভাল তথ্যচিত্র বানাতে। প্রয়োজনে কলকাতার একটা টিম নিয়ে গিয়ে কাজটা করব। সেটার পর নিজে রিমেক করব কি না তা নিয়ে ভাবব। একটা সিনেমাকে রিমেক করা যাবে কি না সেটা একটা বিজনেস কল। তবে এ সবের আগে চাইব ছবিটা মুম্বইয়ে আমার ইন্সটিটিউটের ছাত্রেরা দেখুক। ওদের ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা আমি দেখাই। এটাও ওদের দেখা উচিত। কমলেশ্বর বেশ খেটে সিনেমাটা বানিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমি এটাও বলি যে আমি জানি এ ছবি যে সবাই বুঝতে পারবে তা নয়। বা তাঁদের ভাল লাগবে তাও নয়। ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ যাওয়া ন্যারেটিভটার মধ্যে মাঝে মধ্যে হয়তো কিছু পুনরাবৃত্তির অংশ আছে। আসলে ব্যাপারটা একটু অন্য ভাবে দেখা উচিত।

কী ভাবে?
বিভিন্ন মানুষের আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। যখন ছাত্র ছিলাম ঋত্বিক ঘটকের কিছু দিক জানতাম যেটা এ ছবিতে নেই। মজা করতে ভালবাসতেন উনি। খানিকটা ভালনারেবল্ ছিলেন। আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। ঋত্বিক ঘটক ওয়াজ এ ডার্লিং অব হিজ স্টুডেন্টস। তাই আমারও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমি জানি এমন একটা সময় গিয়েছে যখন ঋত্বিক একফোঁটাও মদ খেতেন না....

উনি তো প্রথম দিকে মদ্যপান বিরোধী প্রচার করেছিলেন স্টুডিয়োতে....
হ্যা। সেই ‘কোমলগান্ধার’য়ের স্ক্রিন পুড়িয়ে দেওয়ার পরই অনেক কিছু পাল্টে যায়। পরিচালক হিসেবে বুঝি এটা কতটা ফ্রাসট্রেটিং হতে পারে কারও কাছে।

আপনি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছিলেন...
হ্যা। আমার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। বন্ধুবান্ধবের একটা থাকবে। একটা মানুষের জীবন পর্দায় ধরাটা চাট্টিখানি কথা নয়। হয়তো অন্য কেউ বানালে অন্য পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বানাবে। কিন্তু এটা তো ঠিক যে ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে একটা ফিচার ফিল্ম বানানো হল। এর পরে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে আর কেউ সিনেমা বানাবে ওঁকে নিয়ে। গাঁধীকে নিয়ে তো আর একটা ফিল্ম হয়নি! ‘দেবদাস’কে নিয়েই ভাবুন না কত ছবি তৈরি হল। এই ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হ্যাজ সেট দ্য বল রোলিং। সত্যজিৎ জানতেন সিনেমা বানিয়ে, তাকে প্রোজেক্ট করে কী ভাবে মার্কেটিংটা করতে হয়। আর ঋত্বিক ভাবুন। সিনেমার মার্কেট করা ইত্যাদির তোয়াক্কাই করতেন না। সত্যিটা মুখের ওপর বলে দিতেন। না হলে কেউ কি বলে যে ইন্সটিটিউট আর স্টুডিয়ো গোলাবেন না। মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। একদম আলাদা। তাই উনি ঋত্বিক।

এই যে বলিউডে এত বছর কাজ করে গিয়েছেন, সেখানে ঋত্বিক ঘটকের শিক্ষাটা কাজে লাগিয়েছেন?
খুব খুশি হয়েছিলেন আমি ছবি পরিচালনা করছি শুনে। বারবার বলতেন অভিনেতারা হল টুলস। স্টোরি তুমকো বাতানা হ্যায়। ওটা মাথায় রেখে কাজ করতাম। আমার পরবর্তী ছবি হল ‘কাঞ্চী’। একদম বলিউডি ছবি। নাচগান আছে। খুব গভীর ভাবে দেখলে বুঝবেন ওখানে ঋত্বিক ঘটকের স্পিরিটটা ধরেছি। ফিল্মের মুখ্য চরিত্র একটি মেয়ে। যে ইনার ট্রুথ আর ফ্রি স্পিরিটে বিশ্বাসী। যা ঠিক সেটাই সে ভয় না পেয়ে বলে। আর করেও। এটাই তো ঋত্বিক ঘটকের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.