কোর্টের নির্দেশ মেনে বনধ শিথিলের বার্তা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার দুপুরে বনধ তোলার জন্য ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেন। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, রবিবার সুর নরম করে কার্যত বনধ তুলে নেওয়ার বার্তা দিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। নিজের ‘ফেসবুক পেজ’-এ মাধ্যমে গুরুঙ্গ জানিয়ে দিলেন, তাঁরা মিটিং-মিছিল, আন্দোলন করলেও কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পাহাড়ে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, অফিস খোলা রাখায় ও যান চলাচলে কোনও বাধা দেবেন না। এই খবর পৌঁছেছে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলেও। বিষয়টি জেনেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “আমরা চাই পাহাড়ে শান্তি থাকুক। পাহাড়ের মানুষ ভাল থাকুন। আরও উন্নয়ন হোক।”
বন্ধে ছাড় দেওয়া হয়েছে দুধ বিক্রিতে। দার্জিলিঙের জজবাজারে দুধের
দোকানের সামনে ভিড়। রবিবার। রবিন রাইয়ের তোলা ছবি।
তবে সরকারি সূত্রের খবর, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের বনধ না তুললে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর পুলিশ-প্রশাসন। রাজ্য সরকারের এক শীর্ষ কর্তা জানান, অশান্তি ছড়ানো-সহ নানা হিংসাত্মক ঘটনায় যুক্ত থাকার মামলায় ইতিমধ্যেই ১৮০ জন মোর্চা নেতা-কর্মীকে ধরা হয়েছে। সোমবারের মধ্যে বন্ধ তোলার কথা স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা না করলে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব রকম পদক্ষেপ করবে। এ দিনও মোর্চার আট নেতা-সহ ১৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ দিন বর্ধমানে এক জনসভায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও বলেন, “আলাপ-আলোচনা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশা করি।” গুরুঙ্গের ফেসবুক বার্তার পরে মোর্চার তরফে সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজু প্রধান সাংবাদিক সম্মেলন করে একটু ঘুরিয়ে হলেও বনধ তোলার কথা জানান। তাঁর কথায়, “মঙ্গলবার থেকে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত পাহাড়ে শুধু ‘জনতা কার্ফু’ থাকবে। অর্থাৎ মানুষ স্বেচ্ছায় বার হবেন না। কেউ চাইলে বার হতে পারবেন। কোনও বাধা দেওয়া হবে না।”

এম কে নারায়ণন।
এই রাজ্য সাগর থেকে পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
এর থেকে কোনও অংশ কেটে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয় না
এর পরে সোমবার দার্জিলিং জিমখানা ক্লাবে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সর্বদল বৈঠকও ডেকেছেন বিমল গুরুঙ্গ। যে দলকে প্রতিপদে তুলোধোনা করে মোর্চা, সেই জিএনএলএফ-কে ডাকা হয়েছে। ডাকা হয়েছে তৃণমূলকেও।
যদিও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “মোর্চা আন্দোলন করছে। তারা কেন সর্বদল বৈঠক ডাকবে? এটা রাজ্য সরকারের ডাকা উচিত।” সিপিএম নেতা নিরুপম সেন পাহাড়ের এই পরিস্থিতির জন্য রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রকেও দুষেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য আবার বিমানবাবুর সুরে বলেছেন, “পাহাড় সমস্যা মেটাতে আমরা সরকারের কাছে সর্বদল বৈঠক ডাকার প্রস্তাব দিয়েছি। মোর্চার ডাকা বৈঠকে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না।” তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব সূত্রে বলা হয়েছে, বৈঠকে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেছেন, “আগে ওরা বন্ধ তুলুক, তার পর তো সব ধরনের আলোচনার রাস্তা খোলাই থাকছে।” ঘটনাচক্রে, পাহাড় পরিস্থিতি নিয়ে এ দিন উদ্বেগ প্রকাশ করেও রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন আশা প্রকাশ করেছেন, শীঘ্রই এই সমস্যা মিটে যাবে।
চিন্তিত। দার্জিলিঙের সিংমারিতে, দলীয় দফতরে মোর্চা সভাপতি। ছবি: রবিন রাই।
মোর্চার ডাকা সর্বদলে জিএনএলএফ, গোর্খা লিগ যাবে কিনা, সেটা তারা লিখিত আমন্ত্রণ পেলেই ভাববে বলে জানিয়েছে। মোর্চা সূত্রের খবর, ওই বৈঠকের পরে পাহাড়ে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ আপাতত প্রত্যাহারের রাস্তায় হাঁটার ছক কষা হয়েছে। যাতে বন্ধ ওঠার পরে অন্য কোনও দলের সমালোচনার মুখে পড়তে না-হয়।
কথায়-কথায় হুমকি দিতে অভ্যস্ত বিমল গুরুঙ্গ আচমকা কেন পিছু হটলেন?
মোর্চার অন্দরের খবর, শনিবার মুখ্যমন্ত্রী চরমসীমা বেঁধে দেওয়ার পরে কিছুটা হলেও ঘাবড়ে যান দলের অনেক নেতা-কর্মী। রাত পর্যন্ত আলোচনা হয় মোর্চা নেতাদের মধ্যে। প্রথম সারির কয়েক জন নেতা জানান, রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পাহাড়ের নানা গ্রামে ক্ষোভ তুঙ্গে। যে কোনও সময়ে নেতাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। দলের তহবিল সংগ্রহ নিয়ে সরকারের কাছে স্পষ্ট তথ্য রয়েছে বলেও বৈঠকে বলেন কেউ কেউ। তাতেও উদ্বেগ বাড়ে। রাতেই দিল্লিতে থাকা রোশন গিরিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হয়, কোনও সমঝোতার রাস্তা মিলেছে কি? আশাপ্রদ সাড়া না মেলায় তাঁদের ফিরতে বলা হয়।
এর পরে ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের কাছে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের বিষয়ে জানতে চান গুরুঙ্গ। মোর্চা সূত্রেই জানা গিয়েছে, কয়েক জন আইনজীবী জানিয়ে দেন, উচ্চ আদালত জনজীবন স্বাভাবিক রাখার যে নির্দেশ দিয়েছে, তা অমান্য করলে নেতাদের সকলের গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরে তা নিয়ে আদালত অবমাননার মামলাও হতে পারে। একেই মদন তামাং হত্যাকাণ্ড, সরকারি অফিস, বাংলোয় আগুন ধরানো-সহ কয়েকশো মামলায় গুরুঙ্গরা জেরবার। উপরন্তু, উচ্চ আদালত বিরূপ হলে জটিলতা বাড়তে পারে বলেও অনেকে মোর্চা সভাপতিকে সতর্ক করেন। একই সঙ্গে তাঁরা বলেন, এখন মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় রসদ বিলি করলে আমজনতাকে আরও কাছে পেয়ে যেতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যদি বনধ তোলাতে পাহাড়ে পৌঁছে নানা কর্মকাণ্ড শুরু করেন, তা হলে কী ভাবে সে সব সামাল দেওয়া যাবে, সেই আলোচনা চলে রাত পর্যন্ত।
রাজ্যের কোনও মন্ত্রী যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রসদ বিলি করতে পারেন, এ দিন তার ইঙ্গিত দিয়েছেন গৌতম দেব। তিনি বলেন, “যে ভাবে বন্ধ চলছে তাতে সাধারণ মানুষ অসুবিধায় রয়েছেন। শীঘ্রই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পাহাড়ে যাব। প্রয়োজনে রসদ বিলি করা হবে।” তাঁর নেতৃত্বে আজ, সোমবার কার্শিয়াঙের পানিঘাটায় শান্তি মিছিল ও সভা করবে তৃণমূল।
নেতৃত্বের ডাকে রোশন গিরিরা এ দিন দিল্লি থেকে বাগডোগরায় এসে নামেন বেলা আড়াইটে নাগাদ। রোশন বলেন, “দিল্লিতে কয়েক জন প্রথম সারির মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা কী পদক্ষেপ করতে চলেছি, তা সভাপতি জানাবেন।” বনধ না তুললে যে দিল্লি থেকেও কোনও নিশ্চয়তা মিলছে না, তাও জানান রোশনরা।
ঘটনাচক্রে, রোশনরা ফেরার খানিকক্ষণ পরেই গুরুঙ্গ ফেসবুকে বড় মাপের একটি ‘পোস্ট’ করেন। তাতে ‘ভাঙলেও মচকাবেন না’ এমন একটা মনোভাবও দেখিয়েছেন তিনি। ওই বার্তায় তাঁর দাবি, ‘রাজ্য সরকার যে সময়সীমা দিয়েছে তা আসলে হাইকোর্টের দেওয়া। আমরা কোর্টের রায় শিরোধার্য করতে চাইছি।’ গুরুঙ্গ যে যুক্তি সেখানে দিয়েছেন, তা হল যে জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে উচ্চ আদালত রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে, তার কোনও নোটিস তিনি পাননি। তবে মামলায় রায়ের প্রতিলিপি এ দিন হাতে পেয়েছেন বলে তিনি জানান।
ওই বার্তায় গুরুঙ্গ এটাও লিখেছেন, ‘আমরা বুঝেছি যে হাইকোর্ট বলেছে, যদি জোর করে রেল, সড়ক আটকানো হয়, বাসিন্দাদের স্বাধীন ভাবে চলাফেরায় বাধা দেওয়া হয়, তবে বনধ অবৈধ।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, ‘আগামী দিনের কর্মসূচিতে মোর্চা কোনও রকম বলপ্রয়োগ করবে না। কাউকে বাধা দেবে না। সরকারি অফিস, স্কুল এবং কলেজের সামনে কোনও পিকেটিং হবে না। রেল, সড়ক পথে যোগাযোগ বা নাগরিকদের স্বাধীন চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটাবে না মোর্চা।’ বনধ চলাকালীন দার্জিলিং জেলায় সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন চলাচল করবে বলেও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘টেলিফোন, জল, দুধ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ, দমকল, সংবাদপত্র, হাসপাতাল, সরকারি অফিসের মতো জরুরি পরিষেবায় মোর্চা সমর্থকরা বাধা দেবেন না।’ যদিও গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত বিবৃতি, মিটিং-মিছিল চলবে বলে গুরুঙ্গ জানিয়ে দিয়েছেন।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.