রামগোপাল বর্মার ‘শিবা’, ‘সত্য’ বা ‘সরকার’-এর কথা মনে পড়ে? নায়ক সেখানে আপনার-আমার মতোই সাধারণ। কিন্তু পারিপার্শ্বিক চাপে কোণঠাসা হতে হতে এক দিন হয়ে ওঠে মাস্তান, স্মাগলার কিংবা ডন। কলেজজীবনে ব্রাত্য বসুর প্রিয় পরিচালক ছিলেন রামগোপাল। কথাটা মনে হল ব্রাত্যর নতুন নাটক ‘সিনেমার মতো’র শেষ দৃশ্য দেখে। কী হল নায়ক অভিজিৎ দত্তগুপ্তের? ক্যাটক্যাটে হলুদ ব্লেজার, লাল সানগ্লাস চোখে অভিজিৎ বাংলা মদ খেয়ে ‘এই তো জীবন’ গেয়ে ওঠে, সিরিয়ালের ছুটকো অভিনেত্রী দেখলে ছিপ ফেলার চেষ্টা করে! শেষ দৃশ্যে হঠাৎ... কী হয় তার? নাট্যকার সরাসরি উত্তর দেন না, ভাবা প্র্যাকটিস করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। এই যে নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করা, এখানেই মনে হয়, নাট্যকার দড়ির ওপর হাঁটছেন। চড়া দাগের অভিজিৎ এই নাটকে সারাক্ষণ ‘আর্ট ফিল্ম’কে ঠোক্কর মেরে যায় বলেই ভয় ছিল। যে মুখ্যমন্ত্রী উৎসব থেকে ভোটপ্রচার, সবেতে টলিউডের সঙ্গেই বেশি স্বচ্ছন্দ, তাঁর শিক্ষামন্ত্রী আর কী নাটক লিখবেন! বরং অভিজিৎ বলে উঠবে, ‘আমিই এক এবং একমাত্র সংস্কৃতি’! কিন্তু না, শেষে জানা গেল, নাট্যকার শিল্পের সঙ্গে তঞ্চকতা করেননি।
রাজনীতিতে বাঙালি নাট্যকার নতুন নয়। উৎপল দত্ত ছিলেন। তারও আগে, মন্মথ রায় কংগ্রেস করতেন। কিন্তু এঁরা ভোটে দাঁড়াননি। এবং শুরু থেকেই রাজনীতিতে। ব্রাত্য তেমন নন। একটা সময় তাঁর কোনও নাট্যদল ছিল না। যে দলের হয়ে নাটক লেখার হাতেখড়ি, সেই ‘গণকৃষ্টি’ থেকে বেরিয়ে আসতে হল। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পর মমতার মঞ্চে উঠে আরও সর্বনাশ! ‘কৃষ্ণগহ্বর’ কয়েকটি শোয়ের পর বন্ধ হয়ে গেল। ব্রাত্যর নতুন নাটক চমকে দিল একটি সংলাপে। ‘পাওয়ার যদি হাতে না থাকে, কেউ তোমাকে পুঁছবে না। আর সেটা তোমাকে স্টেট, মিডিয়া আর মানি-ই দিতে পারে।’ ব্রাত্যই কি তবে আমাদের অভিমানী নীলকণ্ঠ? নিজের নাট্যসত্তা বাঁচাতে রাজনীতির গরল পান ছাড়া গত্যন্তর ছিল না? |
ব্রাত্যর ‘হেমলাট’ বলেছিল, ‘পচা, সব পচা। মুখে ভাল ভাল কথা আর বন্ধুকে, নিজেকে মারছে। আমাদের সবার ভেতর পুঁজভর্তি ঘা।’ ঘায়ের জ্বলুনি তাঁকেও সহ্য করতে হয়েছে। পরিবর্তনের আগে অনেক নেতার ধারণা ছিল, বিদ্বজ্জনেরা বেশির ভাগই ধান্দাবাজ, দায়িত্ব না নিয়ে সরে যাবে। ব্রাত্যকে ভবিষ্যৎ কী ভাবে মনে রাখবে, শিক্ষক পেটানো বন্ধ করতে পারবেন কি না, অন্য প্রশ্ন। কিন্তু পুড়তে পুড়তেও নাট্যকার সত্তাকে বাঁচিয়ে গিয়েছেন। ‘সুপারি কিলার’ লিখে সুপ্রিয় দত্তকে বলেছিলেন, ‘যদিও তুমি সিপিএম, কিন্তু রোলটা বস্, তোমার জন্যই।’
মনে পড়ে চেক নাট্যকার ভাত্স্লাভ হাভেল-এর কথা। ব্রাত্য নেতা নন, একনিষ্ঠ সৈনিক। হাভেল কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জেলখাটা নেতা। তাঁর নেতৃত্বে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় ‘পরিবর্তন’। নতুন দেশ গড়তে গত জমানার লোকদেরও সাদরে ডেকে নিলেন, সাড়ে তিন দশক ধরে অত্যাচারের বুকনি দিলেন না। দেশছাড়া মিলান কুন্দেরার সঙ্গেও বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি।
বাংলা মঞ্চে সঙ্ঘ ভেঙে গেল কেন? ব্যক্তিকেন্দ্রিক আচ্ছন্নতা? মন্ত্রী হওয়ার পর এটাই ব্রাত্যর প্রথম নাটক। এবং সেখানে তুমুল অভিমান, ‘কোনও দিন কাউকে মুখে অন্তত ভাল বোলো না।... অন্যকে ভাল বললে নিজে যদি ছোট হয়ে যাই।’ সবাই আমাকে ভাল বলবে, এই আকাঙ্ক্ষা যে ব্রাত্যর কত নাটকে! ‘পেজ ফোর’ নাটকে গিরিধারী: ‘যে মুহূর্তে তুমি জীবনে যা চেয়েছিলে, পেলে না, অমনি গালি দিতে শুরু করলে! তোমার সঙ্গে বড় কাগজ নেই? কমিউনিস্ট পার্টি আছে। পার্টি নেই? অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউশন আছে। সব জায়গায় এক হায়রার্কি, এক ঘেটো, এক ডন হওয়ার জন্য খেয়োখেয়ি।’ অভিমানী ব্রাত্য বোঝেন না, সবাই কাউকে মহৎ বলে না। বেন জনসনও সমসাময়িক শেক্সপিয়রকে নিয়ে বলতেন, ‘লাতিনটা কম জানে। গ্রিক আরও কম।’ যে সমাজ একবাক্যে বলে, উনিই একমাত্র মহৎ, সে ঠিক সুস্থ নয়। কমিউনিজ্ম কিংবা ফ্যাসিজ্ম রোগে আক্রান্ত।
এখানেই তফাত। ব্যক্তি নয়, সিস্টেমকে তুলোধোনা করেছিল হাভেলের নাটক ‘ষড়যন্ত্রীরা’। স্বৈরতান্ত্রিক এক দেশে বিপ্লব ঘটেছে। সেনাকর্তারা গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে উন্মুখ। হঠাৎ জানা যায়, প্রাক্তন স্বৈরশাসক বিদেশে বসে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ভাঁজছেন। সেনাকর্তারাও পাল্টা ষড়যন্ত্রে। কিন্তু খবর আসে, প্রতিপক্ষ আরও ভয়ঙ্কর। এরা গুলি ছুড়লে ওরা বোম মারবে। শেষে বোঝা যায়, নতুন সরকার এত দিন যা শুনছিল, নিজেদেরই ছকা ষড়যন্ত্রের বিবরণ। রাজা আসে, রাজা যায়। কিন্তু ক্ষমতার চরিত্র বদলায় না।
ক্ষমতাবিরোধী ভিন্নমত ছিল ব্রাত্যর নাটকেও। তাঁর এক নাটকে দুই যুযুধান দল বানর হয়ে যায়। আর এক নাটকে নারদ কার্ল মার্ক্সকে বোঝান, ‘এখানে সবাই সি পি এম। যে সি পি এম করছে, আর যে বিরোধিতা করছে, সবাই সি পি এম।’ নতুন নাটকে সি পি এম নয়। বরং অভিজিতের ছোট ভাই যখন বলে, ‘নয়ের দশকে শুরু হল গানে, ফিল্মে, রাজনীতিতে আঞ্চলিক আইডেন্টিটি খোঁজা।’ উত্তরে নায়ক: ‘ভাই, তুই কি তৃণমূল?’ তৃণমূলের জয় আঞ্চলিকতার উত্থান হল কবে? ওটি দুর্গন্ধ সি পি এমের প্রতি বিরাগ। ব্রাত্য আমাকে সেঁকা পাউরুটি, পচা বানরুটি বলতে পারেন। কিন্তু ওই যে, মিলান কুন্দেরার মোক্ষম উক্তি! দ্য স্ট্রাগ্ল অব ম্যান আগেনস্ট পাওয়ার ইজ দ্য পাওয়ার অব মেমরি আগেনস্ট অবলিভিয়ন। ভ্রান্তির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রামই ক্ষমতাবিরোধী সংগ্রাম।
ব্রাত্য তা হলে ক্ষমতার স্বর? একেবারেই নয়। নাটকের গল্পে আসা চিত্রনাট্যের নাম ‘সিনেমার মতো।’ ওই চিত্রনাট্যই এতক্ষণ নাটক হল? শেষে অভিজিৎ আচমকা ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘আমি তোমার ছেলে, মা। এক বার বল, আমি বাবার মতো নই।’ পুরো নাটকটাকেই যেন উড়িয়ে দিলেন ব্রাত্য। উত্তম-রোমন্থন, বাংলা ছবির হিট গান, এ সব কিছু নয়। মেরে পাস মা হ্যায়। সেটাই সিনেমা! নিজেকে যিনি বিপজ্জনক ভাবে নাকচ করেন, তাঁর পরবর্তী জাগলিং দেখার জন্য ছটফট করতেই হয়।
কেমন হবে সেই নাটক? দশ বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পর হাভেলের উপলব্ধি, ‘নাটক আর রাজনীতির তফাত সাঙ্ঘাতিক। ধরুন, কিছু গোঁড়া অভিনেতা উন্মাদের মতো নাটক করল। ক্ষতি নেই, ওটি বহুত্বের সংস্কৃতি। কিন্তু গোঁড়া রাজনীতিক যদি উন্মাদের মতো পারফর্ম করেন? কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনে সমূহ সর্বনাশ।’ মন্ত্রিত্ব বাঙালি নাট্যকারকে কী উপলব্ধি দেয়, জানতে চাইলে অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। |