হাঁড়ির খবর
কাঙ্ক্ষিত কাকোরির খোঁজে
ছর চারেক আগের দিল্লির সেই সন্ধে যে কী সাঙ্ঘাতিক পয়মন্ত ছিল! তামাম রাজধানীতে খাঁটি কাকোরি কাবাবের সন্ধানে হন্যে হয়ে ফোনাফুনি করতে করতে তার দেখা মিলল ঘর থেকে ঠিক দুই পা বাড়িয়ে। চাণক্যপুরীতে আমাদের ঘাঁটির খুব কাছে অসম হাউসের গায়ে ফুটপাথের সেই খোপ। প্রায় ওপেন-কিচেন। চোখের সামনে দরদরিয়ে ঘামত ঘামতে অক্লান্ত কাবাব-মিস্ত্রিরা শিক থেকে সেই লম্বাটে নাজুক মাংসমণ্ডটি সুড়ুত করে টেনে মুহূর্তে রুমালি রুটিতে মুড়ে ফেলছেন। শুনেছি, অসম হাউজের কোনও ভোজ বা প্রেস কনফারেন্সে এ কাকোরি আপ্যায়নে অনিবার্য। ফিনফিনে রুটির চাদর বিনা এ মাটন কাবাব হাতে ধরা অসম্ভব ছিল। রোলের মতো কামড় বসিয়েই আমি অভিভূত।
মার শহরে এ বস্তুটি আজও ‘বিরলতম’র মর্যাদা পাবে। তাই দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাবীন্দ্রিক দক্ষিণী স্কুলের পাড়ায় এমন বাদশাহি আস্বাদ জিভে মাখলে স্বভাবতই সেই ষোড়শ শতকে চলে গিয়েছি বলেই মনে হবে। কলকাতার নব্য মোগলাই-দাওয়াত ‘ঔধ ১৫৯০’ এই একুশ শতককে তেমনই একটা ষোড়শ শতকীয় অভিজ্ঞতার ভাগ দেওয়ার টার্গেট নিয়েছে। খানদানি কাঠের আসবাব, নরম আলোয় ইতিহাসের রহস্যময়তার পরিবেশ। মিনে করা কাঁসার মানানসই মোরাদাবাদি বাসনে পাতে আসে পরম কাঙ্ক্ষিত কাকোরি। একেও হাতে করে তোলা যাবে না। অল্প ভেঙে ভেঙে খেতে হবে।
বার বার শুনলেও কাকোরি-বিষয়ক একটি গল্প কখনও পুরনো হয় না। কোনও দন্তহীন, বৃদ্ধ নবাবকে মাংস খাওয়াতে না কি কোন ওস্তাদ হেঁসেল-শিল্পী মাথা খাটিয়েছিলেন। তার পরে মিহিতম কুচনো মাটন, পেঁপে না কীসের রস মেখে মশলার আদরে স্বর্গীয় রূপ পেল, সে কীর্তি অমরত্ব পেয়েছে।
দিল্লির সেই ফুটপাথের ঠেক, আল-কৌসরের কর্তা আসফাক আহমেদ বলেছিলেন, ১৮৯৬ সালে তাঁর ঠাকুর্দাই না কি লখনউ থেকে কাকোরিকে দিল্লিতে আনেন। আসফাক-রা কয়েক পুরুষ ধরে লখনউয়ের বাবুর্চি। কলকাতায় এ কাকোরির ঢুকতে ঢুকতে গত শতকের আশির দশক গড়িয়ে যায়। তার বছর দশেক আগে আইটিসি তাদের ‘দমপোক্ত’-এ এই কাকোরি ও লখনউয়ের টুন্ডেওয়ালি ব্র্যান্ডের নাম প্যাকেজ করে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
কাকোরির আধুনিক রচয়িতা টুন্ডেওয়ালির নামমাহাত্ম্য আবার কাবাব-বিশারদ এক টুন্ডা কারিগরের (তাঁর একটি হাত ছোট ছিল) সৌজন্যে। আশির দশকের মাঝামাঝি দমপক্ত-এর কয়েক জন শেফ তাজ গ্রুপে যোগ দেন। তখনই তাজ বেঙ্গলের সোনারগাঁও থেকে কাকোরির প্রথম কলকাতায় পদার্পণ।
মার্কোপোলো রেস্তোরাঁর তুখোড় শেফ অমিতাভ চক্রবর্তী সে সময়ে তাজের হেঁসেলে শিক্ষানবিশ। তিনি দেখেছেন, দমপোক্ত থেকে আসা শেফ দুগার্চরণ ও তাঁর টিম কী ভাবে কাজ করতেন। লখনউয়ের গলির স্টাইলে তখনও তাঁরা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে কিমা-মাংসকে পিটিয়ে পিটিয়ে কাকোরিচিত করে তুলতেন। যেমন অনেকের বিশ্বাস, শিলে বাটা মশলার বিকল্প হয় না। তেমনই কেউ কেউ বলেন, মেশিন বা মিন্সারে হাজার চেষ্টাতেও কাকোরির সেই টেস্ট আসে না। মাংস পিটিয়ে নিলে, তার ভেতরের নির্যাসটা বেরিয়ে যে ভাবে মাখো-মাখো হয়ে ওঠে, তাতেই কাকোরি অন্য মার্গে পৌঁছে যায়। আল-কৌসরের আসফাকভাই অবশ্য আর একটি মোক্ষম চালের কথা শুনিয়েছেন। এক কেজি কুচনো মাংসে ১০০ গ্রাম ফ্যাট থাকতে হবে। যে-সে ফ্যাট নয়। গুরদা মানে কিডনির চর্বি। তাতে কাকোরি ‘চিকনা’ হবে। সাবধান! এই ফ্যাটের মাত্রা বেড়ে গেলেই কাবাব ‘টপক যায়েগা!’
দেশপ্রিয় পার্কের পাড়ায় ‘ঔধ’-এ এমন কঠিন সাধনাটি সম্ভব হচ্ছে কিশোর-কিশোর মুখশ্রীর এক সদ্যযুবা মনসুর রহমানের হাতে। কে বলবে ছেলেটি মালদহের বাঙালি! বাপ-দাদার পরম্পরা মেনে ছোটবেলা থেকে লখনউয়ের টুন্ডেওয়ালির আখড়ায় কাটিয়ে মনসুরের বাংলা নিতান্তই ভাঙা ভাঙা। লখনউয়ের আমিনাবাদ, হজরতগঞ্জ, লালবাগে বালক বয়স থেকে কাবাব পাকাচ্ছেন। এ বার কলকাতায় কাজের সুযোগ পেয়ে তাঁর ‘বস’ তথা রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয়ে চাঁদনি চক থেকে সরঞ্জাম এনে মাংস কুচিকুচি করার মেশিন অ্যাসেম্বল করেছেন। আর তার পর কেরামতির শুরু।
কলকাতা বা সর্বত্রই কাকোরির নাম করে সাধারণত যা খুশি তাই চলে! শিক কাবাবকে কাকোরি বলে চালায় যে কেউ। লখনউজাত কাকোরি মাল্টিন্যাশনাল বার্গার নয়। যতই গ্লোবাল হই আমরা, কিছু কিছু শিল্প সর্বজনীন হবে না। উত্তর কলকাতার সন্দেশের মতো এটাও হেঁজিপেঁজি আদমির কম্মো নয়। শেফ অমিতাভর মার্কোপোলোতেও অবশ্য কাকোরির ব্যবস্থা আছে। তা ঔধে কাকোরি মুখে দিয়ে চমৎকৃত হতেই হল। কাকোরির মতোই আদরের আর একটি কাবাব হল গালাওটি। কাকোরি লম্বাটে। গালাওটি টিকিয়াকৃতি। মাংস, মশলা, চর্বির সমাহারে যেন ঠান্ডাবিহীন আইসক্রিম। টকটকে লাল পানসে চিকেন টিক্কা যখন কলকাতা ছেয়ে ফেলছে, তখন এ সব রাজকীয় স্বাদ খুঁজে পাওয়া সোজা কাজ নয়। কয়েক বছর আগে ক্রেজি কাবাব-এর গালাওটিও মনে ধরেছিল। তখন এইটুকুনি পিৎজার টপিংয়ের মতো পরোটাখণ্ডের গালচেয় চড়ে সেখানে গালাওটি আসত। ঔধে গালাওটি-কাকোরির সঙ্গী লখনউয়ি পরোটা। এ রুটি কত দূর খাঁটি লখনউয়ি জানা নেই! তবে অতি ফিনফিনে দোসার থেকে সামান্য পুরু কার্যত তেলবিহীন ময়দার স্বাদ অতি উৎকৃষ্ট। কাবাবই হোক বা রেস্তোরাঁর বিবিধ আওয়াধি পদ নিহারি, নার্গিসি কোপ্তা, ডালগোস্ত, ব্রেন মশালা, কিমা-কলেজি সব কিছুর সঙ্গে পরোটা দারুণ যাচ্ছে। এত ফিনফিনে বলেই কাবাব বা গ্রেভির মশলার সঙ্গে তার বিরোধ নেই। বরং নিঃস্বার্থ ভাবে গ্রেভি-কাবাবের বিকাশে এ পরোটা উৎসর্গীকৃত প্রাণ।
হালে সিরাজ-আরসালান-রা ছাড়াও এ শহরে সিরাজের দাওয়াত-ই-সিরাজ থেকে শুরু করে ছোটে নবাব, নওশি জানের মতো তরুণ বিরিয়ানি ক্ষেত্র বা মোগলাই ঠেক মাথা চাড়া দিয়েছে। এই বাজারে ঔধ-এর আওয়াধি প্রাপ্তিযোগ নিয়ে আরও দু’-একটি কথা মাথায় রাখবেন। আমাদের চেনা বিরিয়ানি ছাড়াও হাঁড়ি-বন্দি ঘি-সুরভিত ঝরঝরে লখনউয়ি বিরিয়ানির সুযোগ নেওয়া যায়। মাংসের গুল্লি ভরপুর মোতি বিরিয়ানি বা মাটন বিরিয়ানি, যেটা খুশি চলবে। কলকাতা বলে বিরিয়ানির সঙ্গে ফাউ ডিমও থাকছে। শেষপাতে শাহি টুকরা, ফিরনি, আরম্ভে বাদামের সরবতও বেশ। ফিরনিটি নির্ভার, সফেদ। সাবির ছাড়া এই ধরনের হাল্কা ফিরনি কলকাতায় কোথাও হয় বলে জানা নেই।
আবার কাকোরির কথায় ফিরি। কাকোরি মহান সন্দেহ নেই, কিন্তু কোনও কোনও রসিক আবার কাবাব বা সেঁকা-পোড়া মাংস বলতে বর্রা কাবাব-ই বোঝেন। একটু হাড়ের গায়ে লেগে থাকা কয়লার গন্ধমাখা তুলতুলে কচি পাঁঠার স্বাদ। এই কাবাব মনের মতো হলে জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ফিকে হয়ে যায়!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.