ব্যাগ গুছিয়ে... ...পাহাড় ঘুমায় ওই
তুমি তো মেঘ ভালবাসো, রাত্রি। পাহাড়ের গাভীর মতো চরে বেড়ানো মেঘ। সবুজ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রেখা তাদের মাঝখানে কখনও সখনও উঁকি দেয়। ডুবে যায় আবার।
আমার পছন্দ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। উন্নত শিখরে এসে পড়ছে শেষ বেলার সোনা আলো। ঝাঁঝিয়ে উঠছে যেন চারদিক। তার পরে ধীরে ধীরে সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে রং। সোনালি, গোলাপি থেকে ক্রমে ছায়াময় ধূসর।
জুন মাসে শিখর চট করে চোখে পড়ে না। মেঘের সঙ্গে তার বিষম আড়ি। চটপট মুখ লুকিয়ে নেয় আড়ালে। দিনরাত তখন অপেক্ষায় থাকি, কখন সামান্য মেঘ সরে দেখা দেবে এক টুকরো শৃঙ্গের আবছা মুখ।
আবার নভেম্বরে বর্ষা শেষ হলে ছোটা মাঙ্গওয়ার অন্য ছবি। তবু, জুন হোক বা নভেম্বর, ভাল লাগে এই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা ছোট জনপদ।
এক দিকে মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে সবুজ পাহাড়, দেওয়ালের মতো। যেন সেখানেই পৃথিবীর শেষ। ও প্রান্তে যেন কিছু নেই, অসীম শূন্যতা ছাড়া। মনে হয়, ওই সবুজ পাহাড়ি দেয়াল টপকে যাওয়ার ক্ষমতা নেই কারও। কিছু দূর গিয়ে অবশ্য সেই দেয়াল নেমে এসেছে নীচের গ্রামের কাছে। অন্য দিকে, নিঃসীম খাদ নেমে গিয়েছে কয়েক হাজার ফুট নীচে নদী পর্যন্ত। তিস্তা, যে কিছুক্ষণ আগেই মিশেছে রঙ্গিতের সঙ্গে, এঁকেবেঁকে চলেছে ভরা যুবতীর মতো। তার পরে, যে ভাবে এসেছিল এক পাহাড়ের ফাঁক থেকে, সে ভাবেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছে অন্য পাহাড়ের বাঁকে।
সন্ধে হলেই ও পারের পাহাড়ে আলো জ্বলে ওঠে। ও দিকে কালিম্পং শহর, যার মাথার উপরে ডেলো পাহাড়। পাহাড়ের পিঠের মতো ছোট জায়গাটি ধরে খানিক হেঁটে গেলে দিগন্ত খুলে যায় সামনে-পিছনে। এখানে দাঁড়িয়েই দেখা যায়, সূর্যোদয়ে ঝলমল করে ওঠে বরফের শিখর। সূর্যাস্তেও।
কিছুটা নেমে এলে ছোট্ট গ্রাম। একটি পথ চলে গিয়েছে গ্রামের পাশ ধরে। চওড়া পথ ধীরে ধীরে সরু হয়েছে, শুধু পা রাখার মতো সামান্য জায়গা ধরে নেমে গিয়েছে অনেক নীচে। পাশে খাদ। পায়ে পায়ে সেই পথে নেমে যেতে ভয় লাগে। ভালও লাগে। শিরশিরে অনুভূতি হয়।
অন্য পথটি খাড়াই নেমে চলে এসেছে ভুট্টা খেতে, যার পিছনে পাহাড়ের গায়ে টুকটাক বসত। ছবির মতো সেই ছোট সমতলকে পাশে রেখে আরও নেমে যাওয়া। পথ আরও কয়েকটা বাঁক আর পাকদণ্ডী ঘুরিয়ে নিয়ে আসে একটি ছিমছাম বাড়ির উঠোনে।
এখানে থাকেন সুখবির রাই। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতেই বাগান করেছেন। পাহাড়ি বাড়ির বাগান, তার গাছ উঠেছে অনেক নীচ থেকে।
তাই হাত বাড়ালেই ফল। দু’-চারটে এনে দিলেন। দাম? না, পাহাড়ি ভালবাসার কাছে ওই শব্দটা অর্থহীন। ও কথা বলায় এমন হাসলেন, নিজের যাবতীয় শহুরে স্মার্টনেস লজ্জা পেয়ে গেল। নিজেই খোসা ছাড়িয়ে খেতে দিলেন আরুচা (এপ্রিকট)। নাসপাতির মতো খেতে চমৎকার ফলের স্বাদে ম ম করছে আপন করে নেওয়ার সুগন্ধ। ভালবাসাহীন রুক্ষ শহরে থাকতে থাকতে যার ঘ্রাণ নিতে ভুলেই গিয়েছিলাম!
ছোট রিসর্টটির কর্মী আরকু। গ্রামের হদিস সে-ই দিয়েছিল। ফিরে আসার পরে হাসি হাসি মুখে বলল, আলাপ হল সুখবীর দাজুর সঙ্গে?
আলাপ কি শুধু এক জনের সঙ্গে হল, রাত্রি? রিসর্টের ছোট্ট কুঁড়ে, পায়ে চলা পাথুরে পথ, গাড়ি যাওয়ার খাড়াই বিপজ্জনক রাস্তা, রাতে উপত্যকা জুড়ে ঝিঁঝিঁর ডাক, এক পশলা বৃষ্টির পরে পাহাড়ের অন্তর থেকে উঠে আসা গন্ধ। আর সাদা-কালো-ধূসর রঙা মেঘেরা তো আছেই। শহর থেকে ব্যাগ ভরে যে মন খারাপের দিস্তা বয়ে এনেছিলাম, তিস্তার কুয়াশামাখা পথ তা নিজের মধ্যে নিয়ে নিল।
দেখা হল না শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। আর হ্যাঁ, ছোটা মাঙ্গওয়া নামে এই জনপদটি যাদের জন্য বিখ্যাত, সেই স্যালাম্যান্ডারও (বহুরূপী) দেখতে পেলাম না। কে জানে, কোথায় মুখ লুকিয়ে রইল সে-ও!

কী ভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে তিস্তা বাজার হয়ে
তিনচুলের ধার ঘেঁষে পৌঁছতে হয় ছোটা মাঙ্গওয়ায়। থাকার জায়গা একটিই।
কখন যাবেন
বর্ষা বাদে বছরের যে কোনও সময়। গ্রীষ্মে বেশ গরম পড়ে। হাজার
পাঁচেক ফুট উচ্চতা হলেও সে সময় দিনের বেলা গরম
কাপড়ের প্রয়োজন বিশেষ হয় না।

ছবি: লেখক




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.