বাস্তুতন্ত্রে ক্ষতির আশঙ্কা
অন্ধবিশ্বাসে ইন্ধন জুগিয়ে চলছে সাপ-নিধন
কসময়ে গরলই সম্বল ছিল তাঁদের। এখন সম্বল গ্রামবাংলার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার।
আর সেই অন্ধবিশ্বাসের সৌজন্যেই নতুন রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন বেদেনিরা। মূলত সাপ ধরাই পেশা এঁদের। আগে সেই সাপের বিষ বিক্রি করে মোটা টাকা মুনাফা হত। কিন্তু পরিস্থিতি বদলানোয় সে রোজগারের পথ এখন কার্যত বন্ধ। অগত্যা তাই মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চলেছেন এঁরা। কী রকম? যেমন কাউকে যদি বশ করতে হয়, তা হলে তাজা সাপের দাঁত শরীরে ধারণের ‘অব্যর্থ’ টোটকা দিচ্ছেন বেদেনিরা। আবার বাতের ব্যথায় কাতর রোগীর জন্য সাপের দেহ পুড়িয়ে সেই ছাই মাখার নিদানও দিচ্ছেন। সাপের চোখ ভিটেতে পুঁতে গৃহ-অশান্তির অবসানের সোজা পথও দেখাচ্ছেন এই যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকজন। ভুক্তভোগীদের এতে সুবিধা হোক কিংবা না হোক, এর জেরে কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে বেদেনিদের। তবে চিন্তা অন্য জায়গায়। বেদেনিদের এই রুজির কারণে যে হারে সাপ নিধন চলছে তাতে নষ্ট হতে পারে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বাস্তুতন্ত্রের নিজস্ব নিয়ম। সে ক্ষেত্রে মানুষের বিপত্তি অবশ্যম্ভাবী।
অন্তত তেমনই ধারণা ‘হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন’-এর সভাপতি অনিমেষ বসুর। তিনি বললেন, “অমানবিক ভাবে সাপ পুড়িয়ে তেল তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশ বিঘ্নিত তো হচ্ছেই, তার উপরে উত্তরবঙ্গ থেকে বহু সাপ ধরে নেপাল ও ভুটানে পাচার করা হচ্ছে।” বাস্তবিক। যেমন শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার পথে রাজগঞ্জ ব্লকের একটি গ্রামে ইতিমধ্যেই তাঁবু গেড়েছেন বেদেনিরা। উদ্দেশ্য?
ভরা পূর্ণিমায় সদ্য ডিম পাড়া কেউটে সংগ্রহ করা। আসলে বাজারে এমন কেউটের চাহিদা বিশাল। তাই সেই ‘অমূল্য সম্পদের’ খোঁজে এখানে ডেরা জমিয়েছেন মূলত বিহারের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেদেনিরা। জানা গেল, শুধু এ বছর নয়। প্রতি বছর, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এঁরা ঘোরাফেরা করেন। বর্ষার শুরু থেকেই এঁদের রমরমা। আসলে মাঠে-ঘাটে জল জমলেই সাপ উঁচু ভিটেতে বাসা খোঁজে। তাই তখন সহজেই সাপকে হাতের নাগালে পেয়ে যান এঁরা।
আগেও এঁরা সাপ ধরতেন। কিন্তু বিষ বিক্রির জন্য ওদের প্রাণে মারতেন না। এই বেদেনিদের কাছ থেকেই বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে যেত নির্দিষ্ট কয়েক জন ফড়ে। যারা কলকাতার কয়েকটি সংস্থায় তা বিক্রি করে মোটা টাকা মুনাফা লুঠত। কিন্তু মুশকিল হয়েছে সেই সব সংস্থা আর বাইরে থেকে বিষ নিতে চায় না। কারণ যে পদ্ধতিতে সেই বিষ বেদেনিরা সংগ্রহ করে তা অবৈজ্ঞানিক- এমন প্রশ্ন ওঠায় সেই বিষের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে। তেমনই ধারণা সর্বজিৎ সিংহের। তিনি এবং তাঁর কয়েক জন সহযোগী দিনের পর দিন বেদেনিদের পিছনে ছুটে বেড়াতেন এই বিষ সংগ্রহের কাজে। তাঁর কথায়, “এমন দিন গেছে এক দিনেই ১২ থেকে ১৪টি গোখরো ও কেউটের বিষ আমরা ওঁদের কাছ থেকে নিতে পেরেছি।” কিন্তু এখন?
সর্বজিতের কথায়, “বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এখন সরাসরি বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদের কয়েকটি সংস্থা থেকে ওই বিষ সংগ্রহ করছে। দামও কম। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ওই বিষ সংগ্রহ করে আনতে যে খরচ পড়ে যায় তার চেয়ে ভিন রাজ্যে দাম অনেক কম পড়ে।”
কলকাতায় বেঙ্গল কেমিক্যাল ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থায় অবশ্য কয়েকটি জরুরি-ভিত্তিক ওষুধের প্রয়োজনে মাঝে মধ্যেই সাপের বিষের প্রয়োজন হত। কিন্তু তা কখনই কোনও ফড়ের মাধ্যমে কেনা হত না। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজার শেখর বসু বলছেন, “এমনিতেই গুরুত্বপূর্ণ ওষুধে বিষ ব্যবহারের আগে নানা সতর্কতা নিতে হয়। প্রয়োজন হলেই নির্ধারিত সংস্থার লোকজনকে সাপ সঙ্গে এনে সংস্থায় সকলের সামনেই সেই বিষ দিয়ে যেতে হয়।”
এক দিকে নিয়মের কড়াকড়ি অন্য দিকে ভিন রাজ্যের কম দামের বিষ। সব মিলিয়ে রুজিতে টান পড়ছিল বেদেনিদের। যেমন বেদেনি লছ্মির দুঃখ ওর কথাতেই ফুটে উঠল “বাবু এখন কেউ আর লিতে আসেক না হমাদের সাপের গরল (বিষ)।” কিন্তু সেটাই কি ওঁদের দুর্দশার প্রকৃত কারণ? মানতে নারাজ অনিমেষবাবু। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে এই সাপ নিধন রুখতে বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনও করেছেন। এমনকী সতর্কও করছেন সবাইকে। তিনিই বললেন, “জানেন তো এদের কেউ কেউ অনেক সময় প্রতারণাও করেন। আসলে মানুষের দুর্বলতা বুঝতে পারলে সহজেই এরা কাজ হাসিল করে বেরিয়ে যায়।” সব মিলিয়ে তাই সাপ নিধন চলছে নির্বিচারে।
তার পরিণতি কোথায় দাঁড়িয়েছে তা বলতে গিয়ে আরও দুশ্চিন্তার কথা শোনালেন প্রকৃতি প্রেমিক ও সাপ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণার লেখক কৌশিক। “কুসংস্কারের দাপটে যে হারে কেউটে নিধন হয়েছে তাতে গত এক বছরে এই সাপের দেখা পেয়েছেন এমন লোক খুব কমই আছেন। কেউটে না পেয়ে ওরা এখন গোখরো, পালাচ আর চন্দ্রবোড়া ধরছে। অবুঝ মানুষদের সেই সব সাপকেই কেউটে বলে চালিয়ে দিচ্ছে ওরা।” কৌশিকের আশঙ্কা, এর ফলে উত্তরবঙ্গে মাঠে-ঘাটে ইঁদুরের উৎপাত বাড়বে। শুধু ফসল নষ্ট নয়, দুরারোগ্য অসুখও ছড়াবে। বৃষ্টির ওপরে নির্ভরশীল উত্তরবঙ্গের চাষবাসে যে ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসছে তা নিয়ে আবারও সতর্ক করলেন কৌশিক। গরলের কারবারিদের ভোল বদলেও তাই বিষক্রিয়ারই আশঙ্কার করছে বিশেষজ্ঞমহল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.