বিচ্ছিন্ন বিপর্যয় নয়, উত্তরাখণ্ড-হিমাচলের অতিবৃষ্টি আসলে ইঙ্গিত দিচ্ছে আরও বড় বিপদের! আবহবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, বিশ্ব উষ্ণায়নের ঠেলায় বদলাচ্ছে বর্ষার চরিত্র। আর তার জেরেই এমন ঘটনা। পাহাড় কিংবা সমতল, আগামী বছরগুলোতে সবত্রই ঘটতে পারে এমন কিছু। তা-ও মাঝেমধ্যেই, আশঙ্কা আবহবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের। তাঁরা বলছেন, উষ্ণায়নের জেরে বিপদ ঘনাতে পারে কলকাতা-মুম্বইয়ের মতো শহরেও। বুধবারই ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু বদল নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। ‘পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ’ এবং বিশ্বের ২৫ জন বিজ্ঞানী তা খতিয়ে দেখেছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী দশ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অন্তত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। এবং তার প্রভাব পড়বে এ দেশের বর্ষার উপরে। আবহবিজ্ঞানীদের মতে, বছর দশেক ধরে বর্ষার গতিপ্রকৃতি ক্রমাগতই বদলে যাচ্ছে। কখনও গোটা জুন মাসে বৃষ্টিই হচ্ছে না (গত বছর যা হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গে), কোথাও আবার এক মাস আগে বর্ষা ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছে (এ বার উত্তরাখণ্ড-হিমাচলে যেমন হয়েছে)। যে ভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে বর্ষার খামখেয়ালিপনাও বেড়ে যাচ্ছে।
সেই খামখেয়ালিপনার সর্বশেষ উদাহরণ এ বছরের বর্ষার গতিপ্রকৃতি। প্রথম দিকে, দক্ষিণবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতে বর্ষা সক্রিয় থাকলেও জুনের মাঝামাঝি থেকেই তা ঝিমিয়ে পড়েছিল। আবার আরব সাগরে তৈরি হওয়া একটি ঘূর্ণাবর্তের জেরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক মাস আগেই ঢুকে গিয়েছে বর্ষা। আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বার যে ভাবে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে একই সময়ে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে, তা-ও কিছুটা বিরল। |
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটি বলছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এ ভাবে বাড়তে থাকলে গ্রীষ্মকালে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রে জলের প্রবাহ কমে যাবে। খরার জেরে কমবে খাদ্য উৎপাদন। আবার কোনও কোনও বছরে অতিবর্ষায় বন্যা হবে। আবহবিজ্ঞানীরা জানান, বর্তমান হিসেব অনুযায়ী ১০০ বছরে এক বার অতি-তীব্র বর্ষার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাপমাত্রা এ হারে বাড়তে থাকলে, আগামী দশ বছরের মধ্যেই প্রতি দশকে এক বার করে অতি-তীব্র বর্ষার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। বদলে যেতে পারে উত্তর ভারতের বর্ষার চরিত্র-ও।
কী রকম?
কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতরের এক বিজ্ঞানীর কথায়, “উত্তর ভারতে বর্ষা তখন মৌসুমি বায়ুর বদলে ভূমধ্যসাগর থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ার উপরে (পশ্চিমী ঝঞ্ঝা) নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। বদলে যাবে বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতিও।” এখন সেই পরিস্থিতিরই কিছুটা আঁচ পেয়েছেন আবহবিদেরা। তাঁরা জানান, উত্তর ভারতে বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। নীচে গরম হাওয়া। দুই স্তরে বাতাসের তাপমাত্রার ফারাক বেশি হওয়ার বায়ুপ্রবাহে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এটা বর্ষার উপরে একটা বড় প্রভাব ফেলছে বলেও তাঁদের দাবি। এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, “তাপমাত্রার এই ফারাকে উল্লম্ব মেঘ তৈরি হচ্ছে। সেই মেঘ থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।”
তা হলে এটাই কি বর্ষার চরিত্র বদলের সূত্রপাত?
তেমনটা কিন্তু মানতে নারাজ মৌসম ভবন। কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (জলবায়ুবিদ্যা) বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বর্ষার পূর্বাভাসের জন্য একাধিক ‘মডেল’ রয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের গবেষকেরা কোন মডেল মেনেছেন তা জানি না।” তাঁর যুক্তি, প্রতি ৩০ বছরে বর্ষার চরিত্র বদলে যায়। ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বর্ষার একটি পর্যায় চলেছে। এ বার ফের বদলের পালা। ২০০০ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ কমবে বলে মনে করছেন তিনি। “কিন্তু জলবায়ু বদলে যাচ্ছে কি না, তার জন্য আরও পর্যবেক্ষণ দরকার।”মন্তব্য বিশ্বজিৎবাবুর।
যদিও মৌসম ভবন বর্ষার পূর্বাভাসের জন্য যে ‘মডেল’ অনুসরণ করে, তা কতটা ঠিক, সেটা নিয়েও কিন্তু গবেষক মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
তবে শহরের অনেক গবেষকের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসেনোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক গৌতম সেন-ও মনে করেন বর্ষার গতিপ্রকৃতি বদলের ইঙ্গিতও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টকেও। গৌতমবাবুর কথায়, “বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটি আন্তর্জাতিক মানের। ফলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকাটাই স্বাভাবিক।”
কিন্তু কলকাতা, মুম্বইয়ের মতো শহরে কী ভাবে প্রভাব ফেলবে উষ্ণায়নও?
আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে, ঘনঘন নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের দাপট সইতে হতে পারে। আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, এ বছরই যেন বঙ্গোপসাগরে একের পর এক নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। শনিবারেও ফের উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। আলিপুরের এক আবহবিদ বলেন, “শুধু নিম্নচাপ-ই নয়, বর্ষাকালে তৈরি হওয়া উল্লম্ব মেঘও বিপদে ফেলতে পারে শহরবাসীকে।” তিনি জানান, বর্ষা দুর্বল থাকলে বন্ধ হয়ে যায় পূবালি হাওয়া। সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে জলীয় বাষ্প ঢুকে তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘ। তা অল্প একটি এলাকার উপরে ভেঙে পড়লে এক ঘণ্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে। থমকে যেতে পারে জনজীবন।
দক্ষিণ কলকাতায় গত বৃহস্পতিবার ঠিক যেমনটা হয়েছিল। |