পাথর ছড়ানো চড়াই ভেঙেই লক্ষ্যভেদ
ওঁদের পথে পথে পাথর ছড়ানো। পায়ে পায়ে কাঁটা। কিন্তু ওঁরা হাল ছাড়েননি। অদম্য মনের জোর এবং এক রাশ স্বপ্নকে হাতিয়ার করে ওঁদের কেউ কেউ জায়গা করে নিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা-তালিকায়। যাঁরা তা পারেননি, সাফল্যের নিরিখে পিছিয়ে নেই তাঁরাও। চড়াই ভেঙে ওঁরা এগিয়ে যেতে চান আরও অনেক দূর।
নুঙ্গি হাইস্কুলের ছাত্র, মহেশতলার নুঙ্গির স্যাঁকরাপাড়ার বাসিন্দা শুভজিৎ ধাড়া ৪৬৯ পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। বাবা তাপস ধাড়া ভ্যানরিকশা চালক। মাসে আয় হাজার তিনেক টাকা। গৃহশিক্ষকতার দাপটে স্কুলের লেখাপড়া যেখানে ক্রমশ গৌণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে স্কুলের শিক্ষকেরাই ছিলেন শুভজিতের ভরসা। তাপসবাবু বলেন, “স্কুলের বাইরে শিক্ষক রাখার সামর্থ্য আমার নেই।” শুভিজিৎ বলেন, “আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। আরও ভাল করে পড়াশোনা করব।”
গৌতম মণ্ডল মিঠুন সরকার সুশান্ত হালদার কৌশিক চট্টোপাধ্যায় অঙ্কুর মাল
উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৬৭ পেয়ে ষষ্ঠ স্থানাধিকারী ইন্দ্রজিৎ সাউয়েরও নিত্য লড়াই দারিদ্রের সঙ্গে। বাবা পুরনো যন্ত্রপাতি সারিয়ে মাসে হাজার তিনেক টাকা আনেন। মা ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের সুপারভাইজার। পূর্ব মেদিনীপুরে ভগবানপুরের নীলকণ্ঠপুর গ্রামের বাসিন্দা ইন্দ্রজিতের পরিবারের আর্থিক দুর্দশা দেখে হস্টেলে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ময়নার চংরাচক জগদীশ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের কর্তৃপক্ষ। বাইরের টিউশন নয়, স্কুলের পাঠ আর অতিরিক্ত সময়ের কোচিং ক্লাসই ছিল ইন্দ্রজিতের ভরসা।
দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি। কখনও রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ। মাথায় করে ইট, বালি বহন। কখনও রাস্তা তৈরির কাজে হাত লাগানো। রাতে বাড়ি ফিরে শরীর চলে না। তখনই জেদটা চেপে বসে শিলিগুড়ি শহরের লাগোয়া ফকদইবাড়ির বাসিন্দা গৌতম মণ্ডলের। বাবা উত্তম মণ্ডল ভবঘুরে। এক সময় দিনমজুরি করলেও কয়েক বছর ধরে কিছুই করছেন না। মা পরিচারিকার কাজ করেন। বাধার পাহাড় ঠেলে উচ্চ মাধ্যমিকে ৩৩২ পেয়েছেন গৌতম। তাঁর স্কুলেরই মিঠুন সরকার পেয়েছেন ৩২৬। তাঁর বাবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাতিল লোহালক্কড় সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। তাঁরও মা পরিচারিকা। সংসার সামলাতে বিদ্যুৎমিস্ত্রির কাজ করেন মিঠুন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশ সেনরায় বলেন, “সংসার চালাতে ওই দুই ছাত্রকে কাজ করতে হত। তার পরেও ভাল ফল করেছে, এটাই বড় পাওয়া।”
বাবা রিকশা টেনে আর মা বিড়ি বেঁধে সংসার চালান। দরমা আর টালির বাড়িতে বৃষ্টি ঠেকাতে নানা জায়গায় পলিথিন আর কাগজ গোঁজা। নেই বিদ্যুৎ-সংযোগও। এত বাধাও হার মানাতে পারেননি কালনার সুশান্ত হালদারকে। নিজের পড়া, বোনকে পড়া দেখানো, বাজার, দোকান, বাবার রিকশা সাফাইয়ের নিত্য কর্তব্য পালন করেই উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৩১ পেয়েছেন কালনার মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্র। ভরসা ছিল স্কুল আর এলাকার কয়েক জন শিক্ষক, যাঁরা বিনা বেতনেই সাহায্য করতেন। আর ছিল একরোখা জেদ।
জয়িত্রী সিংহ কর্মু মাহাতো প্রশান্ত মাল ইন্দ্রজিৎ সাউ শুভজিৎ ধাড়া
সুশান্ত বলে, “সারা দিন ধরে শুধু পড়ার সময় বার করার চেষ্টা করতাম। পরীক্ষার আগে আর একটু পেলে সময় পেলে হয়তো আরও ভাল করতে পারতাম।” তাঁর বাবা সুকুমার হালদার বলেন, “ছেলের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া তো আর কিছুই পারিনি। এর পরেও কতটা পারব, জানি না।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের রাঙ্গিয়াম গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ মাহাতো এবং তাঁর স্ত্রী মেনকাদেবী দিনমজুর। অভাবের সংসারে ছেলে কর্মুকে পড়ানোর সঙ্গতি ছিল না তাঁদের। তাই ভর্তি করে দিয়েছিলেন স্থানীয় খড়িকা ভীমার্জুন মহাকুল এসসি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে হস্টেলে থেকেই পড়েছেন কর্মু। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়েই উচ্চ মাধ্যমিকে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৩৯৫। স্কুলের সেরা কর্মুই। সিউড়ি বেণীমাধব ইনস্টিটিউশনের প্রশান্ত মাল কলা বিভাগে ৩৬৪ পেয়েছেন। তিনি ভূগোলে অনার্স পড়ে শিক্ষক হতে চান। মা সিউড়ি ইন্দিরাপল্লির মল্লিকা মাল পেশায় পরিচারিকা। বাবা সুধীর মাল রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। দু’জনের কেউই লেখাপড়া জানেন না।
বেলুড়ের কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের লড়াই লিউকেমিয়ার সঙ্গে। ২০০৯ থেকে চলছে টানা চিকিৎসা। টেস্টের আগেও বারবার জ্বর এসেছিল। তবু ‘সিক বেড’-এ পরীক্ষা দিতে চাননি কৌশিক। আর এই জেদই তাঁকে উচ্চ মাধ্যমিকে ৮২ শতাংশ নম্বর এনে দিয়েছে। এই নম্বরে খুশি কৌশিক। আক্ষেপও আছে। বললেন, “ফুটবল খেলতে কি ভালই না বাসতাম! এখন তো সবুজ মাঠই হারিয়ে গিয়েছে আমার জীবন থেকে।”
দুরারোগ্য ‘অস্টিওজেনেসিস ইমপারফেক্টা’য় আক্রান্ত ঘাটালের কুশপাতার অঙ্কুর মালের ভঙ্গুর হাড়, পেশিও দুর্বল। হুইলচেয়ারে দিনযাপন। একটানা কাঠের বেঞ্চে বসে ক্লাস করা সম্ভব নয় বলে স্কুলেও যেতে পারতেন না। বাড়িতে পড়াশোনা করেই ৪১০ পেয়েছেন বিদ্যাসাগর হাইস্কুলের এই ছাত্র। অঙ্কুর বলেন, “আমি ইংরেজিতে অনার্স পড়ব।”
পরীক্ষার আগে ডেঙ্গি হয়েছিল। দীর্ঘদিন নাসিংহোমে চিকিৎসাধীন থাকায় লেখাপড়া করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের জয়িত্রী সিংহ। এর পরে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে চান তিনি।
২৮ ফেব্রুয়ারি, উচ্চ মাধ্যমিকের ঠিক ১৩ দিন আগে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে গিরিশ পার্কের সরকার বাই লেনের বাড়িতে আগুন লাগে। দগ্ধ হয়ে মারা যান অদিতি গুপ্তের বাবা বেদপ্রকাশ গুপ্ত এবং মা কবিতা গুপ্ত। বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে জখম হন অদিতিও। লেলিহান আগুনে হাত জ্বলে যায় তাঁর। ওই দুর্ঘটনার ধাক্কা সত্ত্বেও অদিতি উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছেন ৩৬৭।
দারিদ্র হোক বা দুরারোগ্য অসুখ কিংবা দুর্ঘটনার মার, এঁদের সকলেরই মন্ত্র চরৈবেতি।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.