সমাজের সঙ্গে নিরন্তর
সংঘর্ষ ছিল ওর

ই অবস্থায় কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব। এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এটা হতে পারে না। এ রকম একটা জলজ্যান্ত মানুষ কী করে চলে যাবে? সব কী রকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ও তো শু্যটিং করছিল ওর নতুন ছবির! রহস্য উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। তাহলে কি ও রহস্য করছে? জীবনের চিত্রনাট্যের শেষে এ রকম একটা বিষাদময় মোড় ও কী করে রেখে গেল?
মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে নানা প্রশ্ন। এটা তা হলে ওর চিত্রনাট্যের একটা দুর্বল মুহূর্ত। কোন যুক্তিতে এ রকম ভাবে কেউ অকস্মাৎ চলে যেতে পারে? না, ঋতুর কাছ থেকে এ ধরনের হঠকারিতা প্রত্যাশিত নয়। প্লটের এমন খুঁত আশা করা যায় না।
নাকি ভুল ভাবছি?
হয়তো ও সব ব্যাপারেই যেমন স্বতন্ত্র, যেমন স্বাধীনচেতা, যেমন বিশিষ্ট, তেমনই এক অমোঘ সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল নিজের জীবন দিয়ে। ওর চলচ্চিত্রভাষের মধ্যে দিয়ে যে ভাবে ঋতু বিস্ফার ঘটিয়েছে নানা সামাজিক সত্যের, মনের অতলে ডুব দিয়ে তুলে এনেছে ব্যক্তিজীবনের নানা গহন অস্বস্তিকর সত্য, জীবনচরিতের অজানা দরজা-জানলা খুলে দিয়েছে, আমাদের মুখ ফিরিয়েছে যাপনের এমন কিছু প্রবল মুহূর্তের দিকে, ঠিক সে
ভাবেই ও নিজের জীবনের চিত্রনাট্যে একটা ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিয়ে গেল। আমাদের বিপন্ন করে দিয়ে গেল, নির্বাস করে দিয়ে গেল। ও শূন্য করে চলে গেল জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার। ‘জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের তোমার অসহ্য বোধ হল...।’
আসলে ঋতু আদতে একটা অন্য মাপের মানুষ। চলচ্চিত্রকার হিসেবে ওর অনন্য কদর আগেও হয়েছে, এখনও হবে, ইতিহাসেও থাকবে। ও যে ভাবে প্রায় একক ভাবে বাংলা ছবিকে খাদ থেকে তুলে এনে আবার সম্মানের স্থানে স্থিতধী করেছিল, তা প্রবাদ হয়ে থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের যে রমরমা, তার বিসমিল্লায় রয়েছে ঋতু। ও যদি পথটা খুলে না দিত, দিশারী না হত, তা হলে আন্দাজ করা মুশকিল আজকে বাংলা ছবির হাল কী হত! এই ক্ষেত্রে ওর ভূমিকা ‘আইকনিক’।
কিন্তু ঋতুকে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র জগতের মানুষ বললে ভুল হবে। ও নানা ভাবে নিজেকে বিস্তার দিয়েছিল। আমি সাম্প্রতিকের খুব কম চলচ্চিত্রকারকে দেখেছি নিয়মিত নাটক দেখতে। ঋতু নিয়মিত নাটক দেখত এবং আলোচনা করত গভীর ভাবে। এমনকী নাটক নিয়ে লেখালিখিও করত। মনে পড়ে ২০০০ সালে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ দেখার পরে (ও তখন আনন্দলোকের সম্পাদক) সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, ও আমাকে হিংসে করে। অসূয়ার কথা যে এমন শৈল্পিক আদরে প্রকাশ করা যায়, সেটা ঋতুর কাছ থেকে শিক্ষণীয়। আবার অপছন্দের কথা ও খুব রূঢ় ভাবে বলতে পারত। তেমনি ভালো লাগলে সে কথা খোলাখুলি বলার উদারতার কোনও অভাব ছিল না। ‘রাজা লিয়ার’ নাটক দেখার পরে ও আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। তাতে অনেক কথার পর লিখেছিল, “কোনও দিন স্টেজ মুছতে হলে জানিও, এসে মুছে দিয়ে যাব।” পড়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ রকম ভাবে বলার মন ক’জনের থাকে, ঔদার্য ক’জনের থাকে?
ঋতুর কাছে ২০০২ নাগাদ একবার যাই ‘রক্তকরবী’ নাটকের পোশাক পরিকল্পনার প্রস্তাব নিয়ে। এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিনের মধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছিল অনেক পোশাক-সামগ্রী, অনেক ছবি। ওর মনে হয়েছিল যক্ষপুরীর সবাই হবে নেড়া। ওর কথায় মনে পড়ে গিয়েছিল হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা। ওর প্রস্তাবে আমার সব অভিনেতারা রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে বারে নাটকটা আর করে ওঠা হয়নি। পরে যখন করেছিলাম, তখন ঋতু ছবির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার প্রযোজনাও ও ভাবে হয়নি।
ঋতুকে বাইরে থেকে দেখে মনে হত, ও বেশ সুখেই আছে। নানা ধরনের সাজগোজে, পোশাক-আশাকে মজায় রয়েছে। ওর ছবির প্রযোজকের কোনও অভাব নেই। দেশজোড়া সব অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই ওর ডাকে কাজ করতে এক পায়ে খাড়া।
নাম-যশ-প্রতিষ্ঠা সব রয়েছে। কিন্তু ওকে একটু ভিতর থেকে চিনলেই বোঝা যেত, ওর সঙ্গে সমাজের একটা নিরন্তর সংঘর্ষ চলছে। ওর যাপন নিয়ে, ওর যৌনতা নিয়ে, ওর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে এক অসীম কৌতূহল ছিল সমাজের। ওকে একটা সহজ সামাজিক সমীকরণে মেলাতে না পারার কৌতূহল। সেই কৌতূহলের মধ্যে ছিল এক সামাজিক গোঁড়ামির শ্লেষ, কৌতুক। ঋতু সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাকে সমাজ যত সনাতনী স্বাভাবিকত্বে একাত্ম করতে চেয়েছিল, ততই সংঘাত বেড়েছিল। ঋতু আরও একা হয়েছিল। কিন্তু ওর সৃষ্টিশীল মনটাকে কে আটকাবে? ওর চলচ্চিত্রের মেধাকে কে আটকাবে? ও সমাজকে কখনও ওর জীবনে ‘ইন্টারভিন’ করতে দেয়নি। বরঞ্চ ও অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছে।
শেষ দিনেও ‘ইন্টারভিন’ করতে দিল না। ঘুমের মধ্যে শেষ সংঘাত ঘোষণা করে চলে গেল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.