প্রান্তিক মানুষের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি
তিনি কি সমকামী ছিলেন? আমি জানি না। তিনি কি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছিলেন? তাও আমি জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি, এ সব ঘোষণা স্বয়ং তিনি করলেও এই মুখরোচক চর্চাময় সাড়ে বত্রিশভাজা গসিপ-পরিকীর্ণ কৌম সমাজের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া পঞ্চাশ ছোঁয়া এক আশ্চর্য হিরের আংটিকে আমরা হারালাম।
সত্যিই এক হীরক খণ্ড। সকালে দূরভাষে যখন খবর এল ঋতুদা আর নেই, তার পর থেকে বন্যার মতো এসএমএস ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ ইজ ডেড’ বা ‘ঋতুপর্ণ চলে গেলেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি সারা শরীর জুড়ে একটা ইলেকট্রিক শক যেন অনুভব করলাম। কথা বলতেই ভাল লাগছিল না। মনে পড়ছিল, এই তো কিছুদিন আগেই ওনাকে শেষ দেখলাম সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে নিলেন ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কার। কথাও হল। নতুন থিয়েটার দেখার কথা বললাম। বললেন, শ্যুটিং শেষ করেই দেখবেন। আমি গিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল।
শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ব্রাত্য বসু। —নিজস্ব চিত্র
মনের ফ্ল্যাশব্যাক অন করে দেখলে মনে পড়ছে, ঋতুদাকে প্রথম দেখি প্রায় কুড়ি বছর আগে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর সামনে। সদ্য ‘উনিশে এপ্রিল’ রিলিজ করেছে। তাঁর সেই চিরাচরিত দ্যুতিময় অদ্ভুত পোশাক আর মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। চোখ জুড়ে কৌতুক আর মেধা ঝিকমিক করছে। একটু গোলগাল চিভু (ঋতুদার ভাই শিল্পনির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ, পরে আমার প্রাণের বন্ধু) আমাকে বলেছিল, ওরা নাকি ছোটবেলায় ঋতুদার গাল টিপে দিয়ে বলত, “আমাদের টেডি বিয়ার!” সকালে চিভুকেও ‘কল’ করেছিলাম খবরটা পেয়ে। ও কথা বলতে পারছিল না, আমিও।
কত আড্ডা হয়েছে ঋতুদার সঙ্গে। চিভুর সঙ্গেই প্রথম ইন্দ্রাণী পার্কে যাওয়া। মা, বাবার কথা বলতে গেলেই ঋতুদার মুখচোখ পাল্টে যেত। আমি বুঝতাম, সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্য, শিল্প এ সব নিয়ে কথা বলার সময় ঋতুপর্ণ এক মানুষ। আর, সন্তান ঋতুপর্ণ সম্পূর্ণ আলাদা। তা ছাড়া তাঁর মনের গভীরে এক ছেলেমানুষ লুকিয়ে থাকত, যা খুব বেশি লুকিয়ে রাখতে পারতেনও না ঋতুদা। ভিতরের বাচ্চাটা ছিটকে বেরোত কথা বলার সময়। তা ছাড়া তিনি ছিলেন সেই বিরল শিল্প জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষ যিনি অক্লেশে, অনায়াসে সাহিত্য নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারতেন।
আমার মনে পড়ছে ওই ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়ি... ঘন ঘন চা... ঘোর শীতেও দু’টো এসি ষোলোতে চলছে, আর পায়ের কাছে কম্বল রাখা আলো-আঁধারিতে ভরা ঘরে ঋতুদা হাসি মুখে বলছেন, “কম্বল জড়িয়ে নে, ঠাণ্ডা লাগবে!” এত বেশি ব্লাড প্রেসার আর এত অজস্র ওষুধ ওঁকে খেতে হত যে, গরম একদম সহ্য করতে পারতেন না।
আমি তবু এটুকু বলতে পারি, একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যখন আমরা যাই, অনেকে কাজ করেন। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। জীবন তো প্রায় ট্রেনের মতোই। কামরায় কেউ ওঠেন, কেউ নেমে যান। শিল্প সংক্রান্ত কাজ অনেকেই করেন, শিল্পী ক’জন হন? আমি সামান্য কর্মী হিসেবে বলতে পারি, আমার সময়ে আমার কাজের সূত্রে যে কয়েক জন মাত্র শিল্পীকে আমি দেখেছি, ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁদের অন্যতম। এই আমরা-ওরা খচিত টানাপোড়েনময় বঙ্গসমাজে বাঙালির মধ্যবিত্ততা, মধ্যচিত্ততা, তার অনেক বাঁক বদল, মানবসম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী রহস্যময় ইঙ্গিত, পরিবারের একক (Unit) বদলে ভেঙেচুরে একক (Alone) মানুষের আবেগ ও আর্তনাদ বারবার ধরা পড়েছে তাঁর ছবিতে। কোনও তন্নিষ্ঠ গবেষক যদি গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে বঙ্গজীবন নিয়ে গবেষণা করেন, তার নানা সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা তিনি খুঁজে পাবেন যে ক’টি মাধ্যমে, তার অন্যতম হল ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা। নারীর নিজস্বতা, তার আত্মপ্রদান, লিঙ্গ রাজনীতি আর যৌনতা সম্পাদিত প্রান্তিক মানুষের সোচ্চার বার্তা কেউ যদি খুঁজতে চান, তা হলে তাঁকে ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা দেখতেই হবে।
স্প্যানিশ পরিচালক পেদ্রো আলমোদোভার যে বলেছিলেন, এই সময়ের চলচ্চিত্র শুধু অর্থনৈতিক অর্থে প্রান্তিকতাকে চিহ্নিত করবে না, সর্ব অর্থেই তাকে আঁটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে এই উক্তির ভারতবর্ষীয় একমাত্র প্রতিতুলনার নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ।
কেউ এক জন বড় মানুষ বলেছিলেন, সত্যিকারের শিল্পীরা মৃত্যুর পর আকাশের তারা হয়ে যান। ঋতুদার সম্পর্কেও আমার এই কথাটা ভাবতে ইচ্ছে করছে।
ইচ্ছে করছে ভাবতে, তিনি ওপর থেকে এই ধোঁয়া-ধুলো-কাদা-আনন্দ-হর্ষ-প্রেম-বেদনা-অভিমান ভরা আমাদের এই সময়কে হাসি মুখে দেখবেন। দেখতেই থাকবেন। একদম অমর হয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.