রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
ল্যাজে পা
মুজরিম ফেসবুক নয়। ইন্টারনেট প্রণম্য চরিত্র। সোসাইটিতে এক-সমুদ্র অবদান। লিসবন আর সুন্দরবনকে এক ক্লাসের পাশাপাশি বেঞ্চে বসিয়ে দিয়েছে। তার পর যখন কম্পিউটারে দোস্তির দোকানগুলো খুলল, অমনি জগতের যাবতীয় বিরহ, মন খারাপ, বন্ধুর দূরে সরে যাওয়া, একলাএকলি বসে থাকারা বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বিদেয় নিল। কিন্তু তার সঙ্গে এই মানবজাতির একাংশ সোশাল হতে গিয়ে সমস্তটা রামগোপাল বর্মা কি আগ বানিয়ে ফেলল। টর্চার টর্চার।
ধরুন, আপনি রাস্তায় ঘুরছেন, বা কনসার্ট শুনতে গেছেন, কিংবা রেস্তরাঁয় ডিনারে। কস্মিন কালেও দেখেননি শোনেনি এক্কেবারে চেনেন না, এমন কেউ কি এসে দুম করে আপনার হাত ঝাঁকিয়ে হ্যাল্লো বলে যায়? ওটা সিনেমায় রাজেশ খন্না ভাল পারতেন, মেয়েদের সঙ্গে কখনওসখনও হয়ে থাকে, তা-ও সংখ্যায় গোনাগুনতি। ভাগ্যিস, অপমানের ভয়টা এখনও বেশির ভাগের জয় করা হয়নি। এই বার ওই ফেসবুকের পাতায় ঢুকুন, কল্পনা তুরন্ত বাস্তব। বাঁ দিকে কলার কাঁদির মতো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলছে। কাঁহাতক কাটাব, ডিলিট করতে করতে অনামিকা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে যন্ত্রণা, ফি দিবসে পাঁচ-পাঁচটা অমূল্য মিনিট অক্কা।
ও দিকে মিউচুয়ালে যারা, কম যায়? ফেসবুকের আউটসাইডে না চিনলেও রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেবে। যাব্বাবা। মানে a+b : b+c = a+c। এই ফর্মুলা মানলে, বিয়েবাড়ি গিয়ে নতুন লোক দেখলে, তৎক্ষণাৎ তার পাশে চেয়ার টেনে খোশগল্পে বসে পড়া যায়। হোস্ট দু’জনকে পরিচয় না করিয়ে দিলেই বা সঙ্কোচ কী? একই লোকের চেনা যখন, সে-ও তো ইয়ারদোস্ত। বুঝলাম, প্রচুর বন্ধু দুরন্ত হেল্দি জিনিস। কিন্তু কেন বন্ধু হতে চাইছে, প্রোফাইল পড়ে সমমনস্ক ভাবছে, কারও মুখে আমার গল্প শুনেছে, না কি স্কুলের উঠোনে লক অ্যান্ড কি খেলতে দেখত, না পাড়ার প্যান্ডেলে আবৃত্তি করতে শুনেছিল— সে সব একখানা মেসেজ-এ লেখে না কেন? ভেবে বুঝলাম, ও হি স্মার্টনেস।
আর এইটাও কি সেই স্মার্টনেস-ই? এই যে, হাবিজাবি ছাতার মাথার মতো দেখতে-শুনতে স্টেটাস আপডেটগুলো? দাঁত নড়ছে, তুলতে গেলুম, প্লিজ প্রে ফর মি। আগে তো জানতাম এ সব কথা শুধু মা-বাবা বড়জোর ছোট মাসিকে জানাতে হয়। ফেসবুকে ঢুকলে দেখি, আরে না রে, ফ্রেন্ডলিস্টের ৫৬৪ জনকে গলা ফাটিয়ে বলার জিনিস এ সব। হাওয়া দিচ্ছে শীত করছে, রান্নার দিদি চায়ের দোকানির সঙ্গে পালিয়ে গেছে তাই আমিই চা বানিয়েছি, পাগলে কামড়ে দিয়েছে, বউ ধরে মেরেছে এ সব পড়ে পড়ে আমার মাথাতেও রোজ যানজট। বাড়ি ফিরে খিদে পেলে মাকে বলব না ফেসবুকে লিখব পুরো গুলিয়ে ফেলছি।
ও দিকে শুনলাম সত্যজিৎ রায় নাকি কোন সিনে-সমালোচকের লেখা পড়ে খেপে উঠে লিখেছিলেন, ‘সিনেমাটা একটা বারোয়ারি শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে...পকেটে পাঁচ সিকা পয়সা এবং হাতে ঘণ্টা তিনেক সময় থাকলে যে কেউ যে কোনও ছবিই দেখতে পারেন এবং তা নিয়ে মন্তব্যও করতে পারেন।...আশঙ্কা হয় এ সব লেখা অন্তত কিছু সংখ্যক পাঠক তথা দর্শকের মনে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে না কি?’ ভাগ্যিস তিনি আর নেই। নইলে ফেসবুকে এই পোস্টের পর পোস্ট আবোলতাবোল সিনেমা-রিভিউ পড়লে কী করতেন মাথাতেই আসছে না। আমার অল্পবুদ্ধি মস্তিষ্কটি এইটুকুই বুঝেছে যে, সিনেমা রিভিউ করতে কোনও বিশেষ পড়াশোনার পরোয়া করতে হয় না। আগে সিনেমা দেখে এসেই কোন সিনে ক’টা ভুল, ডিরেক্টরটা কত বড় মূর্খ, হিরোটার যে কিস্যু হবে না হাঁউমাউ করে শোনাতাম না? এখন ফেসবুকে লিখে দিই। তার নীচে আরও সাঁইত্রিশখানা, আরও ভয়ংকর বিদ্যেযুক্ত কমেন্ট জমা হয়। একটা কথা বলা আর লেখার মধ্যে যে খেলনা বাইক চালানো আর মরণকুয়োয় মোটরবাইক ভ্রুমভ্রুম-এর পার্থক্য সে সব জ্ঞান...
সেন্সগুলো হুড়হুড়িয়ে বেসিনে উগরেই এক দল ফেসবুকে ঢোকে। তার পরই এদের কাজ প্রাণের নেট-বান্ধবকে ঘাড় ধরে নিজের পছন্দের গ্রুপে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া। গ্রুপ ব্যাপারটা যখন চালু হল, কত লোকের চোখে জল এল। যাক, রাতে বাড়ি ফিরে কানাডা কলকাতা কুয়ালা লামপুরে আবার কত দিন পর দরজা ভেজিয়ে কমন রুমের আড্ডাটা জমবে। তার পর? গ্রুপের গুঁতো। মানে, আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। চেনা মুখ। শুধু সেই জন্যই বিল্টু আপনাকে টানতে টানতে ওদের পঞ্চব্যঞ্জন ক্লাবে ঢুকিয়ে বসিয়ে দিল। এখানে ওরা রান্না নিয়ে আলোচনা করে। যাচ্চলে। আপনি তো না রাঁধুনি, না খাদ্যরসিক। তাতে বিল্টুর ক্যাঁচকলা! তার গ্রুপ দিবারাত্র আপনার বাড়ি বয়ে এসে যখন-তখন চিৎকার করে বলতে থাকবে: ও দাদা, শুনছেন, বৈকুণ্ঠ মাইতি নিজের হাতে তৈরি মাছের কচুরির ছবি আটকেছে। ও দিদি, শিপ্রা বউদিদের বাড়িতে আজ চিংড়ি ডুব খাচ্ছে ধনেপাতার চাটনিতে।
অচেনা, অল্প চেনা, মুখ চেনা— সব্বাই সব স্টেপ টপকে সরাসরি ‘ফ্রেন্ড’। কেবল একটা ছবি আটকে দেখুন এই ‘ফ্রেন্ড’দের কেমন আসল রূপ বেরোয়। যে দল জানে না কী ভাবে আলাপ করতে হয়, বন্ধুত্ব কী ভাবে হয়, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো আসলে কেন আছে, তারা যে সোশালি বিহেভ করতেও জানবে না, কোথায় থামতে হয় জানবে না: কীসের নতুন কথা? পাবলিক, প্রাইভেট, ফর্মাল, ইনফর্মাল, বয়স, সম্পর্ক, সব রকম তালমাত্রাজ্ঞান ফুঃ। প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যখন দেখা হচ্ছে, তখন ‘তুমি কী সুন্দর’ বলারও হিম্মত নেই। অথচ ছবির নীচে সবার চোখের সামনে তাকে ‘লুকিং ড্যাম সেক্সি’ লিখে দেওয়াই যায়। কারও দেওয়ালে কোনও ভাল কথা লেখা থাকলে, তাকে কিচ্ছুটি না বলে টুকলি মেরে নিজের বলে চালানোও যায়। আর মাথায় যদি যুগ-সই প্যাঁচালো কীট থাকে তো ছবি তুলে নিয়ে মর্জিমত বিগড়ে, তার সম্মান ছিঁড়েখুঁড়ে নেটে ছেড়ে তাকে অপদস্থও করা যায়। আরে তুম নে মুঝে দোস্ত কহা না, ফির? দোস্তো মে ইয়ে সব চলতা হ্যায় না ইয়ার?
সবার ওপরে? ট্যাগ। তার কাজটা ছিল, জরুরি বিষয়ে জনগণকে নক করা। সে ধার কে ধারে? ট্যাগ আছে বলে প্রতি ঘণ্টায় মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে, চাঁদ, সূর্য, পাহাড়, জঙ্গল, গরু-ছাগলের স্টুপিডস্য স্টুপিড ছবি চেনা লোকজনকে ডেকে ডেকে বিলি করতে হয়। তাতেও রক্ষে নেই। আছে অন্যের দেওয়াল। সেখানে সব সময় নিজের যাচ্ছেতাই ছবিগুলো লাগিয়ে আসতে হয়। ও মা, নিজের দেওয়ালে সাঁটলে কেউ যদি না দেখে! তো উপায় হল, নিজের বাড়ির বাথরুমের ছবি চিপকে অন্যের দেওয়ালটি ময়লা করে অপেক্ষা করা, কখন সে মিথ্যে মিথ্যে একখানা কমেন্ট বসায়, বাহ্ সুন্দর। আর যদি সত্যিটা লেখে, ভাই নিজের ছবিতে, বা এ রকম ভালগার কিছুতে আমাকে ট্যাগ করবি না, হিস্টিরিয়া! এমন বললি? বলতে পারলি? ছ্যা, তুই তো আচ্ছা আনসোশাল!
এরকম সোশাল ওভারডোজ হয়ে গলা আটকে মরার থেকে আনসোশাল হয়ে বাঁচাই দেখছি ভাল ছিল। নিজের দেওয়ালে তালা মেরেছি, ট্যাগও বন্ধ। তাতে, আমার দেওয়ালে লোকে নিজের নাক ডাকার ভিডিয়ো লাগাতে পারে না। সঙ্গে অবশ্য আমার প্রবাসী বন্ধুটাও ক্লাস টেনের গ্রুপফোটোটা আটকে একটু মন কেমন শেয়ার করতে পারে না। কুছ পানেকে লিয়ে কুছ খোনা পড়তা হ্যায়।
এর পরও পাবলিক শব্দটাকে গালি বলে ইউজ করলে কিছু মনে করার থাকে? গালি তো নিজেরাই নিজেদের বানিয়েছে। এ দেশের এই ‘পাবলিক’-ই তো মেট্রোর যন্ত্রণা, দুর্গাপুজোর আসল অসুর, পাঁচ বছরের বাচ্চার বিভীষিকা! আর তারা মাত্তর ফেসবুকটাকে বিগড়ে তার বারোটা পাঁচ বাজাতে পারবে না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.