রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
দি ওপিয়াম ক্লার্ক
ব্বইয়ের মাঝামাঝি ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল-এ, আফিম চাষের মক্কা বলে যার বদনাম। ট্রেকিং আমার মোটেই ভাল লাগে না। তবু জীবনে সব কিছুই অন্তত এক বার চেখে দেখা উচিত, তাই। এক দিন সন্ধেবেলা কয়েক বোতল বিয়ার খাওয়ার ফাঁকে ট্যুর গাইড আমার হাতে একটা বই গুঁজে দিল, যার বিষয়বস্তু আফিম। ড্রাগ্স নিয়ে কোনও দিনই মাথা ঘামাইনি, তবু আড়চোখে পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ চোখে পড়ল এক আজব লাইন ‘ক্যালকাটা ওয়াজ দি ওপিয়াম ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’। বলে কী! আমি তো খোদ কলকাতারই লোক, জম্ম-কম্ম এখানে, বাপ-ঠাকুরদার নামে রাস্তাঘাটও রয়েছে এই শহরে। অথচ আমিই জানি না ব্যাপারটা! আফিম খাওয়া তো দূরের কথা, বয়সকালে গাঁজার কলকে ছাড়া অন্য কিছুতে টান দিতে কারওকে দেখিনি কখনও। মাসখানেক পর মন্ট্রিয়ল-এ ফিরে (তখন ওখানকার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করি) লাইব্রেরি থেকে আফিমের ওপর একটা বই ধার নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। মাত্র কয়েক পাতার মধ্যেই যাকে বলে দিব্যচক্ষে ভেসে উঠল আমার প্রথম বই দি ওপিয়াম ক্লার্ক।
আফিম পর্বের আগে কয়েকটা ছোটগল্প ছাড়া (যার মধ্যে ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’) বিশেষ কিছু লিখিনি। একটা বড় লেখার জন্য মন উসখুস করছিল। মাস্টারির কাজ কোনও দিনই মনে দাগ কাটেনি, রোজগেরে চাকরির ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্যের হাতছানি। কী লিখি, কী লিখি? আফিমের খোঁজ পেয়ে হাতে স্বর্গ পেলাম। এ তো যে-সে প্লট নয়, যাকে বলে ক্লাসিকাল নভেলের খোরাক। এক দিকে ইতিহাসের টান, অন্য দিকে হরেক জাতির ফুলশয্যার খাট পাতা। হায়ার সেকেন্ডারি সিলেবাসের ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলে যাওয়া আফিমের গল্প শুরু বিহারে, আর শেষ চিনে। পটনার ফ্যাক্টরি-তে তৈরি হত আফিমের দলা, যার নাম ‘বেঙ্গল মাড’। বাংলায় জন্ম নয় বটে, তবে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সবই আলিপুরের অক্শন হাউস-এ। এখান থেকেই আফিম কিনে সাহেবরা পাড়ি দিত চিনে। জাহাজ খালাস করে কিনে নিত সাংহাই-এর দোকানিরা। তার পর ডিঙি নৌকো চড়ে আফিম পৌঁছে যেত চিনের ঘরে ঘরে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গোটা জাতটাকে নেশাখোর বানিয়ে ফেলেছিল ইংরেজরা। এমনই এই ব্যবসা, যার মন্ত্র একটাই আফিম খাও আর ব্রিটিশ কোম্পানিদের লাভ বাড়াও।
শুধু ব্যবসায়ী নয়, আফিমের রঙিন দুনিয়ায় ভিড় জমিয়েছিল আরও অনেকে নেশাখোর, জাহাজের কাপ্তান ও খালাসি, বিবিধ ষড়যন্ত্রী, পাদরি, কেরানি, বিপ্লবী, বারবনিতা, প্রেমিক ও খুনি। এদের নিয়েই আমার গল্প, যার মুখ্য চরিত্রে জানবাজারের ব্রাহ্মণ সন্তান হিরণ্যগর্ভ চক্রবর্তী, টোলের পরীক্ষায় ফেল করে শেষমেশ ম্লেচ্ছ ইংরেজদের আফিম কোম্পানির কেরানি। নেশা, হাত দেখা। আমরা, যারা রাইটার্স বিল্ডিং-এ গিয়েছি, তাদের আফিমের অক্শন হাউস চিনতে অসুবিধে হবে না। সার সার ডেস্কের ওপর ফাইলে মুখ গুঁজে কেরানিকুল। এখানেই হিরণবাবুর হাতেখড়ি। আর বন্ধুত্ব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, পার্সি, শ্যামবাজারের ঘটি আর এক জন বিশিষ্ট সাহেব, অক্শন হাউস-এর সুপারিনটেনডেন্ট জোনাথন ক্র্যাব-এর সঙ্গে। ক্র্যাব ভারতপ্রেমী। তাঁর বউ লিলিয়ান, কোম্পানির বড়সাহেব বিয়ে করে জাতে ওঠা গরিব ঘরের মেমসাহেব ও ঘোরতর আফিমখোর। হিরণের ডাক পড়ে ক্র্যাবকে সংস্কৃত শেখাতে। পরিচয় হয় লিলিয়ানের সঙ্গে। তৈরি হয় অদ্ভুত ত্রিভুজ।
কলকাতার পাট শেষ হলে ক্র্যাব রওনা দেন ক্যান্টনে। সঙ্গে যান তাঁর প্রিয় কেরানি হিরণ। তখন ওপিয়াম যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পরাস্ত চিনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপিয়ানরা। এ দিকে নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ প্রাচ্যের জলহাওয়া আর খাওয়াদাওয়ায় নাজেহাল, দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল। এই প্রবাসেই তাঁর প্রথম প্রেম। তত দিনে ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গিয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন, আফিম-উৎখাত যার অন্যতম দাবি। কলকাতা আর ক্যান্টনের পর উপন্যাসের শেষ অধ্যায় আর এক আফিমের শহর মালয়েশিয়ার কুচিং-এ। মুখ্য ভূমিকায় ডগলাস ক্র্যাব, জোনাথন আর লিলিয়ানের পরিত্যক্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সন্তান। হিরণ তার অভিভাবক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ টোকা দিচ্ছে এশিয়ার দরজায়, সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন, সেই সঙ্গে আফিমের গল্পও শেষ।
ক্লাস এইট-এর পর নিয়ম করে ইতিহাস পড়িনি। তাই আফিম-গাথা লিখতে গিয়ে লাইব্রেরিতে তাঁবু খাটিয়ে বসতে হল। বাণিজ্যিক ব্যাপারস্যাপার ছাড়াও, বুঝতে চাইলাম আফিম খেলে মানুষের শরীরে কী কী প্রতিক্রিয়া হয়। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ানরা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাত এই অদ্ভুত আগ্রহ কেন? শুধু তো আফিম নয়, বিভিন্ন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বুঝতে গিয়ে পড়তে হল পামিস্ট্রি, হোমিয়োপ্যাথি, চিনা পোর্সেলিন ও পাল-তোলা জাহাজের কারিগরি, ডাইয়াক প্রজাতির আচার-অনুষ্ঠান আরও হাজারও ব্যাপারস্যাপার। লিখে আর পড়ে কেটে গেল দুটো বছর। মাস্টারি ডকে ওঠার শামিল। এক চিলতে সময় পেলেই লিখতে বসতাম। কলেজে সেমিনার চলাকালীন লাস্ট বেঞ্চে বসে আড়াল করে নিজের লেখার ওপর কলম চালাতাম। অন্য অধ্যাপকরা ভাবতেন, আহা, গবেষণায় কী ঝোঁক ছেলেটার!
এক লাখ শব্দ তো লিখে ফেলেছি। কিন্তু ছাপবে কে? ঘটনাচক্রে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চাকরির প্রস্তাব দিল ১৯৯৯-এ, আর পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে আমি পৌঁছে গেলাম বিলেতে। ইংরেজিতে বই ছাপানোর ব্যাপারে সেই সময় নানা প্রবাদ চালু ছিল। যেমন জানাশোনা না থাকলে এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমার বউ আর মেয়ে ছাড়া ইংল্যান্ডে তখন কাউকে চিনতাম না। অতএব নিষ্ঠাবান বাঙালির মতো প্রকাশক আর এজেন্টদের চিঠি লিখে চিঁড়ে ভেজানো ছাড়া উপায় ছিল না। গোটা সাতেক প্রত্যাখ্যানের পর এক জন লিটারারি এজেন্ট ফোন করে বই পড়তে চাইলেন। তারও সপ্তাহ দুয়েক পর ডেকে পাঠালেন লন্ডনে। তখন আমার অবস্থা অষ্টাদশবর্ষীয় প্রেমিক যুবকের মতো, যে জানে না তার গার্লফ্রেন্ড তাকে সত্যি ভালবাসে, না মিছিমিছি ঘোরাচ্ছে। লন্ডনের এজেন্ট ঘণ্টা তিনেক ধরে ইন্টারভিউ নেওয়ার কায়দায় নানা প্রশ্ন করলেন এই চরিত্র এমন কাণ্ড ঘটাল কেন, গল্পে ওই চরিত্রের ভূমিকা কী। তত ক্ষণে দুপুরের লাঞ্চ জুড়িয়ে জল। শেষমেশ চেপে রাখতে না পেরে বাঙালিসুলভ অত্যাগ্রহে বলে ফেললাম, বইটা কেউ ছাপতে রাজি হবে কি (‘চাকরিটা সত্যি সত্যি হবে তো স্যর’)? ইংরেজসুলভ কায়দায় উত্তর দিলেন, ‘মনে তো হয় হবে।’ সেই মনে হওয়াই হয়ে ছাড়ল। বছরখানেকের মধ্যেই বই প্রকাশিত হল পৃথিবীর সব ক’টি ইংরেজিভাষী দেশে। সামান্য কিছু মন্দ আর প্রচুর ভাল রিভিউ বের হল। ডাক পড়ল দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সভায়। সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেওয়া রপ্ত হল।
তার পর বারো বছর কেটে গিয়েছে। মধ্যে ছ’টি বই। প্রথম বইটা এখনও নানা দেশের বুক-স্টলে দেখি। পুনর্মুদ্রিত হয়েছে অনেক বার। আবার হবে এই বছর। গোটা চারেক পিএইচ ডি আর বেশ কয়েকটা মাস্টার্স থিসিস লেখা হয়েছে হিরণবাবুর উপাখ্যানকে জড়িয়ে। তবে এটা লিখতে গিয়ে একটা ভয়ংকর সত্য অনুভব করেছি লেখার নেশা আফিমের নেশার চেয়েও মারাত্মক। দ্বিতীয়টির জন্য পকেটে পয়সা থাকা দরকার, কিন্তু প্রথমটার বেলায় তা নয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরছিলাম একটা সাহিত্য-সভা সেরে। পথে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টা। চোখ গেল এক সুন্দরীর দিকে। তার পর চোখ ফেরানো মুশকিল। তার কোলে আমার প্রথম বই যে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.