তদন্ত দাবি করিবার সময় তাহার বিশেষণ রূপে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটির ব্যবহার, ভাবিয়া দেখিলে, এক অতি বিপন্ন সময়ের প্রতিফলন। তদন্তের ভার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত থাকিবে, তাহাই যে কোনও আধুনিক রাষ্ট্রে কাম্য। অতএব এই আশা সঙ্গত যে, ভারতে যে প্রতিষ্ঠানগুলি তদন্তের দায়িত্ব পায়, রাষ্ট্র সেগুলিকে ‘নির্ভরযোগ্য’ জ্ঞান করে। অর্থাত্, সেই প্রতিষ্ঠানের তদন্তের নিরপেক্ষতা বিষয়ে নাগরিক নিশ্চিত থাকিবেন সভ্য সমাজে এমনই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতে এই কথাগুলি অলীক ঠেকিবে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট যে ভাষায় সি বি আই-কে তিরস্কার করিয়াছে, তাহার পর যদি কেহ সেই সংস্থার তদন্তের ‘নিরপেক্ষতা’ বিষয়ে সন্দিহান হন, তাঁহাকে দোষ দেওয়া কঠিন হইবে। বস্তুত, সন্দেহটি ক্রমে সর্বজনীন হইতেছে। তাহার প্রকাশও স্পষ্ট। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক দুর্নীতি বিষয়ে সি বি আই তদন্তের দাবি করিয়া জনস্বার্থ মামলা কলিকাতা আদালতে দায়ের হইয়াছিল। লক্ষণীয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করিয়াছেন, কমিশন বসাইয়াছেন। তাহার পরেও সি বি আই তদন্তের প্রবল দাবিতে বুঝা গিয়াছিল, সেই তদন্তের ‘নিরপেক্ষতা’য় অন্তত সকলের আস্থা নাই। এখন নূতন দাবি শোনা যাইতেছে নিছক সি বি আই তদন্তে হইবে না, সংস্থাটিকে কলিকাতা হাইকোর্টের অধীনে কাজ করিতে হইবে। অর্থাত্, সি বি আই-এর উপরও আর ভরসা নাই, এখন আদালতই নিরপেক্ষতার একমাত্র উত্স হিসাবে বিবেচিত। এই অবিশ্বাস ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তির উপর এক তীব্র আঘাত। দুঃখজনক ভাবে, এই অবিশ্বাসকে অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই। ইহাই বাস্তব।
এই অবিশ্বাস শুধুমাত্র সাধারণ মানুষেরই নহে। রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র লিখিয়াছেন, সারদা গোষ্ঠীর মূল চক্রীদের সহিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের সংযোগ না থাকা অতি আশ্চর্যের হইবে। সেই নামগুলি পাছে প্রকাশ পায়, সেই ভয়ে এই চক্রীদের চুপ করাইয়া দেওয়ার চেষ্টা চলিবে বলিয়াই আশঙ্কা। ‘মূল অপরাধীকে রাজ্য পুলিশের জিম্মায় রাখা আদৌ উচিত নহে’ অশোকবাবুর আশঙ্কাটির কত আনা সত্য, সেই প্রশ্ন অবান্তর, আশঙ্কাটি যে আছে, তাহাই মূল কথা। তিনি সাধারণ রাজ্যবাসী নহেন। প্রশাসনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ প্রবীণ রাজনীতিক যখন রাজ্য প্রশাসনের নিরপেক্ষতায় ভরসা রাখিতে পারেন না, তখন বোঝা সম্ভব, বিশ্বাসযোগ্যতায় মস্ত ঘাটতি পড়িয়াছে। এই বিশ্বাসহীনতা দলীয় পক্ষপাতিত্ব বলিয়া উড়াইয়া দেওয়াও কঠিন, কারণ যে অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রীর এই আশঙ্কা, তাহার দায়িত্ব বামফ্রন্ট জমানারই। এই অনাস্থা পশ্চিমবঙ্গ নামক হতশ্রী রাজ্যটির পরম দুর্ভাগ্যস্বরূপ। এই রাজ্যে কার্যত কিছুই নাই। যদি শাসকের নিরপেক্ষতার উপর আস্থাটুকুও না থাকে, এই রাজ্য দাঁড়াইবে কোথায়? উন্নয়ন বহু দূরের প্রশ্ন, এই অবিশ্বাস লইয়া দৈনন্দিন কাজ চালাইয়া যাওয়াও দুঃসাধ্য। দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অদম্য বাসনায় নেতারা স-পুলিশ-প্রশাসন এই অবিশ্বাসের চোরাবালিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভরসা করিতে রাজ্যবাসীর একটি বড় অংশ ব্যাকুল ছিলেন, তাঁহার প্রশাসন আজ এমন আস্থার দেউলিয়া হইল কেন? তাহার দুইটি কারণ আছে। প্রথমত, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বার বার তদন্ত শেষ হইবার পূর্বেই নিজের রায় ঘোষণা করিয়াছেন। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডই হউক বা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যু, মুখ্যমন্ত্রী তদন্ত সমাপনের পরোয়া করেন নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো বিস্মৃত হন যে, তাঁহার কুর্সির বিশেষ গুরুত্ব আছে। তাঁহার তদন্ত-পূর্ব রায়ে তদন্তকারীরা সত্যই প্রভাবিত হন কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু রাজ্যবাসী ভাবিতেই পারেন যে এই তদন্তের নিকট নিরপেক্ষতার আশা অর্থহীন। দ্বিতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা অনেকে দৃষ্টিকটু ভাবে সারদা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। নিরপেক্ষ তদন্ত হইলে তাঁহারা প্রত্যেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হইবেন, এমন কথা বিশ্বাস করা বোধ হয় রাজ্যবাসীর পক্ষে সম্ভব হইতেছে না। ফলে আশঙ্কা হইতেছে, তদন্ত নিরপেক্ষ হইবে না। এই অবিশ্বাস নেতারা নিজ গুণে অর্জন করিয়াছেন। গণতন্ত্রের দোহাই, খানিক লজ্জিত হউন। |