সমস্যা আছে, তাহা স্বীকার করিয়া লইলেই নাকি সেই সমস্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্ধেকখানি জেতা হইয়া যায়। কথাটি বহুলপ্রচলিত। কিন্তু সত্য কি না, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তাহার পরীক্ষা আসন্ন। কঠিন পরীক্ষা। কারণ, মহাকরণ-জয়ের প্রায় দুই বৎসর পরে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রথম বার স্বীকার করিলেন, রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের সমস্যা আছে। এবং, সেই সমস্যায় তাপববিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও আটকাইয়া গিয়াছে। যে কথাটি আর সবাই বহু দিন পূর্বেই বুঝিয়াছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাহা বুঝিতে এত সময় লইলেন কেন সেই প্রশ্ন আপাতত থাক। বিধানসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি যে মুহূর্তে সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্নের জবাবে জমি সমস্যার কথা উল্লেখ করিলেন, একটি ভিন্ন কারণে সোরগোল পড়িয়া গেল। অনেকেই বলিতেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নাকি এই প্রথম বিধানসভায় কোনও প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিলেন। কেহ আবার স্মৃতি খুঁড়িয়া ২০১২ সালের কথা উল্লেখ করিলেন তখনও নাকি মুখ্যমন্ত্রী এক বার সরাসরি জবাব দিয়াছিলেন। যে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত দফতরের সংখ্যা নয়, তিনি দুই বৎসরে দুইটিমাত্র প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিয়াছেন এই তথ্যটিই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা বুঝাইতে যথেষ্ট। কেন মুখ্যমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণের সমস্যার কথা স্বীকার করিতে এত দেরি করিলেন, সেই প্রশ্নটি আর করিবার অর্থ হয় না।
সমস্যা স্বীকার করিয়াছেন বলিয়াই তাহার সমাধানেও উদ্যোগী হইবেন, মুখ্যমন্ত্রী এমন সম্ভাবনায় জল ঢালিয়া দিয়াছেন। জোর করিয়া জমি অধিগ্রহণ করা হইবে না জানাইয়া মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, প্রয়োজনে উড়ালপুল বানাইয়া সমস্যা এড়াইতে হইবে। অর্থশাস্ত্রে তাঁহার দখল যতখানি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তাহার অধিক নহে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাবটিকে গুরুত্ব না দিলেও চলিবে। তাঁহার মানসিকতাটি লক্ষণীয়। রাজ্যের সমস্যা স্বীকার করিয়াও তিনি তাঁহার জেদ হইতে নড়িতে নারাজ। তিনি বহু ভাবে একটি বিশ্বাস তৈরি করিতে চাহিতেছেন সরকার জমি অধিগ্রহণ করিলেই বুঝি তাহা গায়ের জোরে করিবে। সংশয় নাই, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি ভুল তাঁহাকে এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করিতে বিপুল সাহায্য করিতেছে। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই জানেন, অধিগ্রহণের আরও অনেক পন্থা আছে। বস্তুত, সরকার অধিগ্রহণ না করিলে এই রাজ্যে একলপ্তে অনেকখানি জমি পাওয়া অসম্ভব। তবুও তিনি এই বিপজ্জনক খেলাটি ছাড়িবেন না। আপাতত তিনি পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকাইয়া আছেন। সেই পর্ব মিটিলেই লোকসভা ভোট আসিবে। তাহার পর বিধানসভা। সত্যটি স্বীকার করিবার অবকাশ তিনি পাইবেন কখন?
সত্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরাধিকারসূত্রে বামফ্রন্টের নিকট হইতে অনেকগুলি সমস্যা পাইয়াছিলেন। কোনও বড়, কোনওটি অপেক্ষাকৃত ছোট। নবীন শাসকের পক্ষে তাহা সুসংবাদ ছিল না। কিন্তু তিনি একটি সমস্যারও সমাধানের চেষ্টা করেন নাই। অভিযোগ করিয়াছেন, রাগিয়া উঠিয়াছেন, কেন্দ্রের নিকট দরবার করিয়াছেন আর সেই অবকাশে সমস্যাগুলি আরও জটিল, আরও গভীর হইয়াছে। বামফ্রন্ট যে ঋণের বোঝা রাখিয়া গিয়াছিল, তিনি মিতব্যয়ী হইয়া তাহাকে কমাইতে চেষ্টা করিতে পারিতেন। তাহার পরিবর্তে তিনি ইমাম হইতে বেকার, সকলের ভাতা চালু করিলেন, ক্লাবে ক্লাবে ভেট পাঠাইলেন। বুদ্ধদেববাবু জমির প্রশ্নটিতেও বহু জট ফেলিয়া গিয়াছিলেন। এমন জট, যাহাতে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ আটকা পড়িয়াছে। যে কোনও সৎ প্রশাসকের কর্তব্য ছিল সেই জট ছাড়ানো। মমতাদেবী সেই পথেই হাঁটিলেন না, বরং আরও কয়েকটি গিঁট ফেলিয়া তাহাকে রাজনৈতিক মূলধনে পরিণত করিলেন। বাজারের সহিত সঙ্গতিহীন বাসভাড়াও বাম আমলের সমস্যা জনমোহনের লোভ বামপন্থীদেরও কিছু কম ছিল না। মমতাদেবী সেই সমস্যাকে এমন পর্যায়ে লইয়া গেলেন যাহাতে বিধানসভায় দাঁড়াইয়া পরিবহণ মন্ত্রীকে স্বীকার করিতে হইতেছে যে কলিকাতার ৭০ শতাংশ বেসরকারি বাসই আর পথে নামিতেছে না। সমস্যার স্তূপের উপর বসিয়া রাজনীতি করায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কতখানি লাভ, তিনিই জানেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতির অবধি নাই। |