সময়মতো ব্লাড সুগারের রোগীর উপযুক্ত খাবার। ওষুধ। আর পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ।
এই তিনটি বিষয় সুনিশ্চিত করেই গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত, তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে ভবানী ভবনে জেরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিআইডি। তাঁর স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই এই ব্যবস্থা। কারণ, সিআইডি-র হেফাজতে থাকাকালীন মুন্নার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তদন্তের ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। ব্লাড সুগার ও কিডনির সমস্যাজনিত  অসুখে ভোগার কারণে মুন্নাকে রোজ একাধিক ওষুধ খেতে হয়। সিআইডি-ই এখন সেই সব ওষুধ কিনে খাওয়াচ্ছে মুন্নাকে।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, এমনিতেই কলকাতা ছেড়ে টানা ২২ দিন নানা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকার জন্য মুন্নার শরীরের উপর দিয়ে প্রচুর ধকল গিয়েছে। একমাত্র আলিগড়ে টানা তিন-চার দিন ছাড়া অন্য কোথাও এক রাতের বেশি কাটাননি তিনি। গোয়েন্দারা আপাতত ১০ দিনের জন্য মুন্নাকে হেফাজতে পেয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনও কারণে অসুস্থ হওয়ার দরুন মুন্নাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলে সময় নষ্ট হবে। সেই জন্যই যাবতীয় সতর্কতা মেনে তাঁকে জেরা করা হবে বলে স্থির করেছে সিআইডি।
সিআইডি যে-দিন (শনিবার) মুন্নাকে কলকাতায় এনে আদালতে তোলে, তাঁর মেয়ে সাবাতাজ সে-দিনই সন্ধ্যায় ভবানী ভবনে গিয়ে তদন্তকারীদের হাতে তাঁর বাবার প্রেসক্রিপশন দিয়ে কী কী ওষুধ কখন খাওয়াতে হবে, তা বুঝিয়ে দেন। কিন্তু ওই প্রেসক্রিপশন প্রায় আট মাসের পুরনো। তাই সিআইডি সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসককে প্রেসক্রিপশনটি দেখিয়েছিল। মুন্নাকে পরীক্ষা করার পরে সেই চিকিৎসক রবিবার গোয়েন্দাদের জানিয়ে দেন, ওই প্রেসক্রিপশনে যে-সব ওষুধের কথা লেখা আছে, সেগুলি মুন্নাকে দিতে কোনও অসুবিধে নেই। তবে মুন্নাকে যে সময়মতো খেতে দিতে হবে, সেটাও সিআইডি-কে জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসক।
সিআইডি সূত্রের খবর, অনেক সময় অভিযুক্তকে সন্ধ্যা থেকে নাগাড়ে জেরা করতে করতে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করার দরুন রাত ১১টা বেজে যায়। ওই দফায় জেরা শেষ হওয়ার পরেই অভিযুক্তকে রাতের খাবার দেওয়া হয়। কারণ, জেরা মাঝপথে থামিয়ে দিলে অভিযুক্ত মানসিক ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন। তখন ইচ্ছা করে ভুলভাল কথা বলে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু মুন্নার ক্ষেত্রে ঠিক হয়েছে, যখন-তখন, এমনকী রাত-বিরেতে তাঁকে জেরা করা হলেও রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তাঁকে রাতের
খাবার দেওয়া হবে। সে-ক্ষেত্রে প্রয়োজনে জেরা থামিয়ে দেওয়া হবে মাঝপথেই। খাওয়াদাওয়া শেষ করে মুন্না ওষুধ নেওয়ার পরেই গোয়েন্দারা ফের জেরা শুরু করবেন। আর দিনের বেলা সিআইডি তাঁকে খেতে দিচ্ছে ১টা নাগাদ।
শাসক দলের নেতা তথা বরো চেয়ারম্যান বলে সিআইডি কি মুন্নাকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে?
সিআইডি অবশ্য এ কথা মানতে চাইছে না। সিআইডি-র এক কর্তা জানান, ইকবালের ব্লাড সুগারের সমস্যা প্রবল। কিডনিরও সমস্যা আছে তাঁর। সিআইডি-র হেফাজতে আছেন বলেই তাঁর এই সমস্ত শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি তাঁদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। ওই সিআইডি-কর্তা বলেন, “খারাপ কিছু হয়ে গেলে তার দায় আমাদের উপরেই বর্তাবে। এর মানে কিন্তু অভিযুক্তকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া নয়। এগুলো আসলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। এটুকু বাদ দিলে অন্য অভিযুক্তদের সিআইডি-র হেফাজতে যে-ভাবে রাখা হয়, ইকবালকে তার চেয়ে অন্য কোনও রকম খাতির করা হচ্ছে না।”
এই প্রসঙ্গে লালগড় আন্দোলনের নেতা ও দেশদ্রোহে অভিযুক্ত ছত্রধর মাহাতো এবং মাওবাদী নেতা তেলুগু দীপকের কথা তোলেন সিআইডি-র এক শীর্ষ অফিসার। তাঁর কথায়, “আমাদের হেফাজতে থাকার সময় ছত্রধরকে বিশেষ ধরনের খাবার দেওয়া হত। রোজ বোতলে ভরা জল কিনে খাওয়ানো হত। শেষ পাতে টক দই থাকত নিয়মিত। প্রাতরাশে কচুরি-তরকারি কিনেও তাঁকে খাওয়ানো হয়েছিল।” ওই অফিসার জানান, মাওবাদী নেতা তেলুগু দীপকের জন্য বিশেষ দক্ষিণ ভারতীয় খানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভবানী ভবনে। এগুলো বিশেষ ধরনের মেনু। তিনি বলেন, “মুন্নার জন্য তো সে-সব কিছুই করা হচ্ছে না। শুধু নজর রাখা হচ্ছে, যাতে সব্জিতে আলু না-থাকে আর চায়ে যেন চিনি দেওয়া না-হয়।”
কিন্তু জেরায় অগ্রগতি কতটা?
সিআইডি সূত্রের খবর, শনিবার সকালে মুন্নাকে ভবানী ভবনে আনার পরে এখনও পর্যন্ত হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে গুলি চলার ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে কোনও কথা বার করা যায়নি। গোয়েন্দারা জানান, ইবনে ও শেখ সুহানদের তিনি পাড়ার ছেলে হিসেবে চেনেন বলে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন ওই নেতা। কিন্তু ওই দু’জন যে ১২ ফেব্রুয়ারি গুলি চালিয়েছিল এবং সুহানের গুলিতেই যে কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী মারা যান, ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুন্না সেই ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করছেন। কী ভাবে কে যে গুলি চালাল, সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি বলে মুন্না জানিয়েছেন সিআইডি-কে। আজ, মঙ্গলবার গার্ডেনরিচের সেই ঘটনার এক মাস পূর্ণ হচ্ছে। |
