বড়দিন থেকে বর্ষবরণের রাত, শিল্পাঞ্চলে রাতের চিত্রটা বদলায় না একটুও। কুয়াশা ফুঁড়ে ছুটে যাওয়া বাইক থেকে বিয়ারের ক্যান ছুড়ে দেওয়া হয় ফাঁকা রাস্তায়। বাড়ি ফিরতে চাওয়া দম্পতি ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে নাজেহাল হলেও পুলিশি সহায়তা পান না। লাগামহীন এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার একই চিত্র ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের প্রধান রাস্তাগুলিতে।
ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁইছুঁই। ঘন কুয়াশায় সিঁথির মোড়ের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় সিগন্যালে হলুদ আলো জ্বলছে-নিভছে। আর শহরতলির ব্যস্ততম রাজ্য সড়কে যান ছুটছে নিয়ম ভেঙে খেয়াল-খুশি মতো। তারই মধ্যে রাস্তা পেরোচ্ছেন পথচারীরা। টবিন রোডের মুখে পুলিশ কিয়স্কে ঝুলছে তালা। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা হেমন্ত নস্কর তাঁর স্ত্রী আর ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাড়ি ফেরার জন্য যানবাহনের অপেক্ষায়। কিন্তু বাসের দেখা তো নেই-ই, দু’একটি ট্যাক্সি এলেও চালকেরা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে পুলিশের একটি টহলদারি গাড়ি এল বটে। কিন্তু এত রাতে ট্যাক্সি ফিরিয়ে দিচ্ছে দেখেও কী সমস্যা, তা দম্পতির কাছে জানতে না চেয়েই চলে গেল। শেষে বেশি ভাড়ায় ট্যাক্সিতে ওঠার সময়ে হেমন্তবাবুর বক্তব্য, “এই তো শৃঙ্খলা আর পুলিশের হাল!”
রাত সাড়ে ১১টা। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উপরে খালিসাকোটা বাসস্টপের সামনে রাস্তায় লরির লম্বা পার্কিং। |
রাতের অন্ধকারে তালাবন্ধ পুলিশ কিয়স্ক।—নিজস্ব চিত্র |
লরির সামনে একটি পুলিশের গাড়ি থাকলেও ব্যারাকপুর ও বিধাননগর কমিশনারেটের সীমানায় চেকপোস্ট যথারীতি অন্ধকার। তালাবন্ধ। ফাঁকা রাস্তায় লরির পিছন থেকে বেরিয়ে এল চার যুবক। এক জনের হাতে ছোট শাবল। তাঁদের কাছে এলাকায় রাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করতেই পাল্টা প্রশ্ন: ‘আপনারা কারা?’ সাংবাদিক শুনেই উল্টো দিকে ছুট লাগিয়ে উধাও চার মূর্তি। বরাহনগর স্টেশনের কাছে, যেখানে নিবেদিতা সেতু থেকে লরি নেমে এক্সপ্রেসওয়ের দিকে উঠছে, সেখানে হাত পাততেও দেখা গেল দু’টি পুলিশ-গাড়ির দুই কর্মীকে।
রাত ১২টা ২০। কামারহাটি মোড়ে সাগর দত্ত হাসপাতালের সামনে সুনসান বিটি রোডে দেখা মিলল পুলিশি টহলদারি গাড়ির। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির পরিচয় পেয়ে গাড়ির অফিসারের বক্তব্য, “এ ভাবে কাজ হয় বলুন? একটা ভাঙা গাড়ি নিয়ে পুরো কামারহাটি এলাকা, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক পাহারা দেওয়া যায়? উর্ধ্বতনদের বারবার জানালেও আমাদের কথা কে শোনে! অঘটন ঘটলে আমরাই বলি হই সকলের আগে।”
রাত ১২টা ৪৫। কুয়াশার চাদর মুড়েছে শহরতলির রাস্তাকে। সোদপুর চৌমাথায় বন্ধ পুলিশ কিয়স্কের পাশে গুমটির পিছনে তখন জমাটি মদের আসর। কাছেই একটি অনুষ্ঠানবাড়ি থেকে বেরোনো মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বেসুরো গান আর টিটকিরি চলছে মদের আড্ডা থেকে। এরই মধ্যে দেখা গেল, ডানলপের দিক থেকে পাঁচটি মোটরবাইক বেপরোয়া ভাবে ছুটে আসছে। তাতে পাঁচ যুবকের পিছনেই বসে পাঁচ তরুণী।
রাত ১টা ৩০। ব্যারাকপুরের চিড়িয়ামোড়। এখানে পুলিশ কমিশনারের অফিস, ডিসি (ট্রাফিকের) অফিস, রাজ্য পুলিশ ট্রেনিং কলেজ ও বাজার। রাস্তার মোড়ে দাঁড় করানো দু’টি মোটরবাইক। পাশে দাঁড়িয়ে চার যুবক তর্কাতর্কি করছেন। আচমকা রাস্তার মাঝে এসে শুরু করলেন হাতাহাতি। আটকাবে কে? যেখানে খোদ কমিশনারের দফতরে এক জনও নিরাপত্তারক্ষীর দেখা মেলে না!
সিঁথির মোড় থেকে ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড় পর্যন্ত বিটি রোড ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে। শিল্পাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হলেও গভীর রাতে পুলিশি টহলদারি কুয়াশার আড়ালেই থাকে। কমিশনারেটে রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড চালু হলেও রাতে এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাকের সামনে যতটা দেখতে পাওয়া যায়, রাতের শহরতলিতে বিটি রোড-সহ ঘোষপাড়া রোড, ব্যারাকপুর-বারাসত রোড, এস এন ব্যানার্জি রোডের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা কিংবা মোড়ে তাঁদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। আর যে এক-দু’টি জায়গায় পুলিশের টহলদারি চোখে পড়েছিল, রাত বাড়তেই তা-ও উধাও হয়ে গিয়েছে।
এই অবস্থা কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েরও। এই রাস্তার ধারে আছে কিছু পানশালা। সেখানেও নিরাপত্তার অভাব। পানশালার থেকে বেরিয়েও মোটরবাইক ও গাড়িতে হুল্লোড় চলে গভীর রাত পর্যন্ত। শিল্পাঞ্চলের রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। কোথাও মেট্রোর কাজের জন্য গর্ত। আবার খড়দা সুখচর গির্জা মোড়ে আচমকাই ডিভাইডার উধাও। রাতে আলো-আঁধারি পথে মাঝেমধ্যেই যানবাহনকে দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে।
গত বছরের ২০ জানুয়ারি চালু হয় ব্যারাকপুর কমিশনারেট। প্রায় ৬০ লক্ষ লোকের বাস, ২৯৭ বর্গ কিমি এলাকায় ১২টি থানা। নাগরিকদের অভিযোগ, গত কয়েক মাসে একাধিক চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলার তেমন উন্নতি হয়নি। অভিযোগ মানছেন পুলিশকর্মীরাও। তাঁদের যুক্তি, “পরিকাঠামোর অভাবেই এই হাল।” নাগরিকদের আরও অভিযোগ, রাত বাড়লেই বেপরোয়া যানচলাচল শুরু হয়। নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। তবে কমিশনারেটের ট্রাফিক দফতর সূত্রে খবর, নিয়ম অনুয়ায়ী সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকে। তার পরে থাকার কোনও নির্দেশ নেই। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “আমাদের যতটুকু ফোর্স রয়েছে, তার উপরে ভরসা করেই
চলতে হয়। ফোর্স বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তা হলে রাতের নিরাপত্তা আরও শক্তপোক্ত হবে।” |