হত্যা, ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির একের পর এক ঘটনায় ফুঁসছিল বারাসত। শনিবার এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে খুনের পরে সেই ক্ষোভ নামল রাস্তায়। অনেকটা রাজধানী দিল্লির মতোই। অন্য দিকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদেও যে প্রশাসনের বিশেষ হেলদোল নেই, তার আভাস মিলল রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম এক সদস্যের মন্তব্যে। পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বারাসত-কাণ্ডকে নিছক পারিবারিক বিবাদের জের হিসেবে অভিহিত করেছেন রবিবার। যার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ উঠেছে, পার্ক স্ট্রিট-কাটোয়ার মতো বারাসতের এই ধর্ষণ-হত্যাকেও লঘু করেই দেখছে রাজ্য সরকার।
পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড নিয়ে খাস বারাসতেরই তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের সাম্প্রতিক মন্তব্য ঘিরে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর এমনিতেই সরগরম। শুক্রবার কাকলিদেবী এক টিভি চ্যানেলে বলেন, “পার্ক স্ট্রিটে আদৌ কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। যা হয়েছে, তা হল পেশাদার কাজ-কারবার নিয়ে ওই মহিলা ও তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।” পরে অবশ্য সাংসদ দাবি করেন, তিনি এমন কথা বলেননি। সেই বিতর্কের রেশ না-কাটতেই পুরমন্ত্রীর মন্তব্যটি চলতি বিতর্কের আগুনে যেন পেট্রোল ঢেলেছে।
বীরভূমের নলহাটিতে এ দিন এক অনুষ্ঠানের আগে বারাসত-কাণ্ড প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, “এটা পরিবারের মধ্যের ব্যাপার। পুলিশ এক জনকে গ্রেফতার করেছে। নিশ্চিত ভাবে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
কিন্তু পুলিশ যেখানে সবে গণধর্ষণের তদন্ত শুরু করেছে, নিহত মহিলার স্বামী হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তখন এক জন দায়িত্বশীল মন্ত্রী কী ভাবে বিষয়টিকে পারিবারিক বিবাদ অ্যাখ্যা দিতে পারেন, এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেছেন বারাসতের মানুষ। শুধু তা-ই নয়, শনিবারের ঘটনার প্রতিবাদে মোমবাতি হাতে হাজার-হাজার মানুষের যে সুশৃঙ্খল ভিড় এ দিন বারাসতের রাজপথে আছড়ে পড়েছিল, মন্ত্রীর মন্তব্যের জেরে ওই নীরব প্রতিবাদ শেষের দিকে কিছুটা সরবও হয়ে ওঠে। প্রশ্ন ওঠে, আমজনতার ভাবাবেগকে কোনও মন্ত্রী এ ভাবে অপমান করতে পারেন কি না। ক’মাস আগে এই বারাসতেই এক স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক চিরঞ্জিত। এ দিন বিক্ষোভকারীদের মুখে সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। |
পাশাপাশি দিল্লির গণধর্ষণে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বারাসত-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া না-দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বিস্মিত। পার্ক স্ট্রিট থেকে কাটোয়া একাধিক ধর্ষণের ঘটনা রাজ্য প্রশাসন প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি। এমনকী, পার্ক স্ট্রিটের অভিযোগকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, কাটোয়ায় দেখেছিলেন রাজনৈতিক রং। এ দিন বারাসতে বিক্ষোভকারী এক মহিলার আক্ষেপ, “আগে কোথাও ধর্ষণ হলেই মমতা চলে যেতেন। এখন যাওয়া দূর, রা-ও কাড়েন না!” তাঁর দলের এক সাংসদ ও ঘনিষ্ঠ এক নাট্যকর্মী পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের অভিযোগকারিণী সম্পর্কে কুরুচিকর ইঙ্গিত করলেও মুখ্যমন্ত্রী তার প্রতিবাদ না-করাতেও বিভিন্ন মহলে বিস্ময় জেগেছে।
নিহত বধূর ছেলের অভিযোগ অনুযায়ী বারাসত থানার পুলিশ অবশ্য গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে। তাঁর স্বামীর বয়ানের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে এক জনকে। ধৃত ইশা মোড়লের বাড়ি সন্দেশখালিতে, সে বারাসতের সোনাখড়কি গ্রাম লাগোয়া ইটভাটার শ্রমিক। ওই ইটভাটাতেই শ্রমিকদের টোকেন দেওয়ার কাজ করতেন সোনাখড়কির বাসিন্দা মহিলাটি। পুলিশ-সূত্রের খবর: অন্য অভিযুক্তদের খোঁজ পেতে ধৃতকে জেরা চলছে। এ ছাড়াও সাত জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ দিন সিআইডি-র দলও ঘটনাস্থলে যায়। যান ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞেরাও। রবিবার বারাসত হাসপাতালে নিহতের ময়না-তদন্ত হয়। পরে বারাসত হাসপাতালের সুপার পুষ্পেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে আমরা কোনও স্থির সিদ্ধান্ত পৌঁছতে পারিনি। রাসায়নিক পরীক্ষার পরে তা স্পষ্ট হবে।” বারাসত থানার তদন্তকারীদের বক্তব্য: শনিবার সন্ধ্যায় সোনাখড়কি গ্রামে ইটভাটার কাছে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা ওঁত পেতে ছিল। দম্পতির উপরে তারা চড়াও হয়। মহিলাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভাটা-সংলগ্ন জলাশয়ের পাড়ে। এ দিন দুপুরে ওই জলাশয় থেকে একটি রক্তমাখা হাতুড়ি উদ্ধার হয়েছে। খোঁজ চলছে হাঁসুয়া জাতীয় একটি ধারালো অস্ত্রের, ধর্ষণের পরে যা দিয়ে মহিলাকে আঘাত করা হয়েছিল বলে পুলিশের অনুমান।
ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) অনিল কুমার, উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুগত সেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় এ দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেন। সিআইডি-র দলের নেতৃত্বে ছিলেন হোমিসাইডের ডিজি (সাউথ) গৌরীশঙ্কর কাঞ্জিলাল। ডিআইজি বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” এসপি বলেন, “মহিলার পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী গণধর্ষণ ও খুনের মামলা রুজু হয়েছে।” সিআইডি-সূত্রের খবর: প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিক হবে, তদন্তভার সিআইডি নেবে কি না। আপাতত তারা জেলা পুলিশকে সাহায্য করবে।
ময়না-তদন্তের পরে এ দিন বিকেলে মহিলার দেহ সোনাখড়কি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্ষণকে ‘অন্য চেহারা’ দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ তুলে ক্ষোভ জানান গ্রামবাসীদের অনেকেই। “ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালবাসা ছিল। তাই স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে স্বামী আক্রান্ত হয়েছেন।” দাবি বৃদ্ধ গ্রামবাসীর। নিহতের পুত্রবধূ বলেন, “রান্না করছিলাম। রক্তাক্ত শ্বশুরমশাই দরজার সামনে এসে পড়ে গেলেন। কাতরাতে কাতরাতে বললেন, মাকে কিছু লোক পুকুরের ধারে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ওঁকে মারধর করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছে।” ওই মহিলা জানান, তিনি তাঁর স্বামীকে খবর পাঠিয়ে আশপাশের মহিলাদের নিয়ে শাশুড়িকে খুঁজতে বার হন। “কুপি, হ্যারিকেন নিয়ে জলার কাছে গিয়ে দেখি, মা পড়ে রয়েছেন। মাথা, শরীর থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। শাড়িটা গায়ের উপরে কোনও মতে ফেলা।” জানাচ্ছেন তিনি।
অপ্রীতিকর পরিস্থিতি রুখতে এলাকা জুড়ে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করেছে প্রশাসন। তারই মধ্যে প্রতিবাদী মিছিল আয়োজনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক-টুইটারে। অনেকের মোবাইলে মেসেজ পৌঁছয়-- ‘আসুন, এ বার আমাদের পথে নামার পালা।’ পরিচিতের বাড়িতে গিয়েও ডাকাডাকি চলে। কিছু সংগঠনের পাশাপাশি ব্যানার ছাড়াই এ দিন পথে নেমেছিলেন রৌনক, তীর্থঙ্কর, দীপ্তার্ঘ, পূজারা। দিল্লিতে ফ্যাশন টেকনোলজি-র ছাত্র ইন্দ্রনীল সাহা বললেন, “মন-খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে শুনলাম, এখানেও একই কাণ্ড! নিজেকে সামলাতে পারিনি। ফেসবুকে সবাইকে বলেছি মিছিলে আসতে।” স্কুল-পড়ুয়া অদ্রিজা দাসের কথায়, “আমরা ছোট, কিন্তু প্রতিবাদটা তো করতে পারি! দেখি, কে আমাদের ঠেকায়!”
বস্তুতই এমন বিক্ষোভ আগে দেখেনি বারাসত।
চাঁপাডালি-কলোনি মোড়-ডাকবাংলো মোড় থেকে থিকথিকে ভিড়ের মিছিল ঘুরল শহরজুড়ে। সন্ধে নামতেই মানুষের ঢলে ৩৪ ও ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ হওয়ার জোগাড়। নতুন প্রজন্মের হাতে হাত ধরে প্রবীণেরাও, স্লোগান একটাই উই ওয়ান্ট জাস্টিস। কালো পোশাকের মিছিলকারীদের হাতে-হাতে প্ল্যাকার্ড সবাই জাগছে, তুমিও জাগো, আর ঘুমিও না বারাসত।
পুলিশ-প্রশাসন-সরকার, কারও বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ না-করে, স্রেফ মোমবাতির আলোতেই এ ভাবে প্রতিবাদের নতুন ভাষা খুঁজেছেন শহরবাসী। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “আমি আতঙ্কগ্রস্ত। এত কিছুর পরে ফের ধর্ষণ! বিকৃতমস্তিষ্ক মানুষ প্রকাশ্যে চলে আসছে। পুলিশ দিয়ে এ সব বন্ধ করা যাবে না। সবাইকে ভাবতে হবে।”
এ দিন জগন্নাথপুরে যান সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী। তাঁর অভিযোগ, “প্রশাসনিক ব্যবস্থার বেহাল ছবিটা বেআব্রু হয়ে পড়েছে। পথে নামা ছাড়া প্রতিকারের কোনও পথ আপাতত আমাদের কাছে নেই।” রাতে মহিলার বাড়ি যান কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি। তিনি বলেন, “রাজ্যে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কেউ গ্রেফতার হচ্ছে না! আশা করব, মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনকে সংবেদনশীল হতে বলবেন।” দীপাদেবীর দাবি, “কোনও ঘটনাই সাজানো বা বিচ্ছিন্ন নয়। যাঁরা তা বলছেন, তাঁরা তা সাজাচ্ছেন।” |