মাস চারেক আগে দুষ্কৃতীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে মৃত্যু হয়েছিল কান্দি মহকুমার সালার থানার টেঁয়া অঞ্চলের কৈগড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা খোকন ঘোষের (৪২)। খোকনবাবু পেশায় ছানা ব্যবসায়ী ছিলেন। অন্যান্য দিনের মতো চলতি সালের ২৭ অগস্ট দুপুর ট্রেন কাটোয়া-আজিমগঞ্জ লোকালে ছানা নিয়ে জেলা সদর বহরমপুরে যাচ্ছিলেন। আর পাঁচটা দিনে যেমন ভাবে যানসে-ভাবেই ও দিনও টেঁয়া স্টেশনে ট্রেনে ছানা তুলে, বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। বাজারসাউ স্টেশনে ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ থেমে ছিল। তার পর ট্রেনটি সবে ওই স্টেশন ছেড়েছে, এমন সময় চলন্ত ট্রেনে উঠে দুষ্কৃতীরা খোকনবাবুর গলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি কোপ মেরেচেন টেনে, ট্রেন থামিয়ে চম্পট দেয়।
খোকনবাবুর ওই অকালমৃত্যুর পর অন্ধকার নেমে আসে তাঁর পরিবারে। বাবলা নদীর ধারে ছোট গ্রাম কৈগড়িয়া। সেখানে মাত্র পাঁচশো লোকের বসবাস। গ্রামের অধিকাংশ লোকেরই জীবিকা কৃষিকাজ আর গবাদি পশুপালন। খোকনবাবুও সেই কাজ করতেন। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী আর তিন ছেলে ও এক মেয়ে মোট আট জনের সংসারে উপার্জন করতেন একা খোকনবাবুই। দিনভর পরিশ্রম করে সংসার টানতেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব যায় ওঁর স্ত্রী তামালি ঘোষের উপর। বড় ছেলে পলাশ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চাষের কাজ দেখাশোনা করে। জমি বলতে বিঘে সাতেক। কিন্তু নদীর ধারে জমি হওয়ায় বর্ষায় আমন চাষ হয় না। বোরো চাষ করে কোনও ভাবে সারা বছরের চাল জোগাড় হয়। আর মেজ ছেলে নয়ন গতবার ফার্স্ট ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়ছে। দুধের ব্যবসা সামাল দিচ্ছে সে-ই। কাকভোরে বেরিয়ে বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ নিয়ে এসে, সেই দুধ থেকে ছানা তৈরি করেহুবহু বাবার মতোই ওই দুপুর দু’টোর লোক্যাল ট্রেন ধরে বহরমপুরে গিয়ে ছানা বিক্রি করে আসে। ফলে এত কাজ সারার খেসারত দিতে গিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার মুখে। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ খোকন।
তার কথায়, “বাবার স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনা করে চাকরি করি। বাবার স্বপ্নও তো পূরণ করতে হবে। সেই চেষ্টাই করছি।” খোকনবাবুর অন্য দুই ছেলেমেয়ে বছর বারো-তেরো বয়সের। তারা এ বার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। এ ছাড়া বাড়িতে রয়েছে খোকনবাবুর বয়স্ক বাবা-মা সহদেব ঘোষ ও নীলিমা ঘোষ। বয়সের কারণেই কাজকর্ম করকে পারেন না তাঁরা। মা নীলিমা দেবী বলেন, “খোকন আমার একমাত্র ছেলে। গ্রামের সবাই ওকে খুব ভালবাসত। ও-ই তো সংসার চালাত। কিন্তু কেন ওরা আমার ছেলেকে খুন করল, সেই উত্তর আমি এখনও পাইনি।” আর স্ত্রী তামালি দেবী বলেন, “ও বেঁচে থাকতে সবাই খোঁজ নিত, বাড়ি আসত, কিন্তু এখন প্রতিবেশী থেকে কংগ্রেসের নেতাকেউই আর খোঁজখবর রাখে না! কেমন ভাবে সংসার চলছে, সেই খবরও রাখে না কেউ।” তামালি দেবীর অভিযোগ, “এখনও আমরা কোনও সাহায্য পাইনি। এমনকী, ওকে যারা মেরেছে, তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করা হলেও এখনও পাঁচ জনকে ধরতে পারেনি পুলিশ। আমার মেজ ছেলেকে চাকরি করানোর খুব ইচ্ছা ছিল ওদের বাবার। তাই তো ওর যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয়, সেই চেষ্টাই করছি।”
টেঁয়া অঞ্চলের প্রধান, কংগ্রেসের সুবীর প্রামাণিক বলেন, “খোঁজ নেব, যাতে ওই পরিবারকে কোনও সাহায্য করা যায়।” আর টেঁয়া বৈদ্যপুর অঞ্চল কংগ্রেসের সভাপতি দৃশ্যতই বিব্রত নারায়ণ মিত্র বলেন, “খোকন ছিল এলাকার জনপ্রিয় ছেলে। ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস রাখত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত। সেই কারণেই গ্রামে যারা এক কালে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তারাই ওকে খুন করেছে। আমরা ওই পরিবারের পাশে আছি। খবর রাখি, চেষ্টাও করছি, যাতে কোনও সাহায্য দেওয়া যায়।” মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, “এখনও কেন বাকিদের গ্রেফতার করা হয়নি, সেটা দেখব!” |