|
|
|
|
ওয়াঘা-যুদ্ধ |
জুনায়েদ, জামশেদ, ডিআরএস
তিন শত্রুতে চিপকে বধ ভারত
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • চেন্নাই |
|
|
টনি গ্রেগ বেঁচে নেই বলে রক্ষে। নইলে তাঁর হাত থেকে সম্ভবত আজ রেহাই পেত না ভারতীয় বোর্ড। কমেন্ট্রি বক্সে বসে টিম ইন্ডিয়ার দুর্দশা দেখতে দেখতে গ্রেগ নিশ্চয়ই টুইট করে ফেলতেন, “ইন্ডিয়ান বোর্ড এ বার কী বলবে? ডিআরএস নিয়ে তোমাদের মূর্খামিটা বুঝতে পারছ?”
ডিআরএস নিয়ে গ্রেগ বনাম বোর্ড যুদ্ধ নতুন নয়। বহু বার লেগেছে। মাঝে মাঝেই গ্রেগ বলে বসেছেন, ভারতীয় বোর্ড স্রেফ টাকার জোরে, গায়ের জোরে ডিআরএস নিয়ে আপত্তি তুলে যাচ্ছে! এত দিন পাত্তা দেননি এন শ্রীনিবাসন। স্টান্স থেকে একচুলও সরেননি। কিন্তু রবিবাসরীয় বিপর্যয়ের পর কী বলবেন? এই যে ওয়ান ডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ভারত ৬ উইকেটে হারল, নাসির জামশেদ সেঞ্চুরি করে গেলেনদু’টোই কিন্তু অনিশ্চয়তার গর্ভে ঢুকে পড়ত চিপকে ডিআরএস থাকলে। আর আশ্চর্য শোনালেও সত্যি, বোর্ড প্রেসিডেন্টকে তাঁর ঘরের মাঠে বসে দেখতে হল, কী ভাবে নিজেদেরই একগুঁয়েমিতে অপমৃত্যু ঘটছে পাক-বধের সুখস্বপ্নের!
খুব সহজে, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে গেল ডিআরএস। তাঁর দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরির সলিলসমাধি ঘটল। ‘রেফারেল’ নেই জেনেও ভারত অধিনায়ক বারবার ইশারা-ইঙ্গিতে ‘রেফারেল’ চেয়ে গেলেন! আম্পায়ার বিলি বাওডেনের উপর তিতিবিরক্ত রায়না নকল করতে ছাড়লেন না বাওডেনকে! সবই ছিল টিমের অন্তর্জলীযাত্রার চিত্রনাট্যে। |
|
পরিশ্রান্ত। ছবি: উৎপল সরকার |
একটা নয়, দু’টো নয়, একসঙ্গে তিন-চারটে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। ওয়ান ডে দুনিয়ায় অভিষেকটাও টি-টোয়েন্টির মতোই দুর্দান্ত হয়েছিল ভুবনেশ্বর কুমারের। পাকিস্তানের টার্গেট ২২৮, কিন্তু প্রথম বলেই ভুবনেশ্বরের বিশাল ইনসুইং হাফিজকে স্রেফ হতভম্ব করে ছিটকে দিল স্টাম্প। পরের বলেই ভুবনেশ্বর-সুইং আছড়ে পড়ল আজহার আলির প্যাডে। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ। দৃষ্টিহীনও আঙুল তুলে দেবে। বাওডেন দিলেন না। হতাশ ধোনি ইঙ্গিতে ‘রেফারেল’ চাইলেন। উত্তরে এল শুধু বাওডেনের মুচকি হাসি! একটু পরে কট বিহাইন্ডের আবেদন, এবং আবার নাকচ! জামশেদ আজ সেঞ্চুরি কেন, হাফসেঞ্চুরিও পান না। অশ্বিনের বলে তিনিও এলবিডব্লিউ ছিলেন। কিন্তু ওই যে, যখন বাওডেন আছেন, আঙুল আর ওঠে কী করে! ইউনিস খানের ক্যাচটাও তো দিতে চাইছিলেন না। অশ্বিনকে অনেক চেয়েচিন্তে ‘থার্ড আম্পায়ার কল’ জোগাড় করতে হল। আর রায় বেরোতেই টুইটারে, ফেসবুকে বিস্ফোরণ। ক্রিকেটপ্রেমীদের কেউ টুইট করছেন, ‘কুৎসিত আম্পায়ারিং। বাওডেনকেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ দিয়ে দাও।’ কেউ আবার লিখছেন, ‘ধোনি এ বার বুঝুক প্রযুক্তিকে পাত্তা না দিলে কী হয়!’ ক্ষোভটা স্বাভাবিক। আজহার বেশিক্ষণ টেকেননি। কিন্তু শুরুতেই পরপর দু’টো উইকেট চলে গেলে, পাকিস্তান ০-২ হলে, কিংবা জামশেদ আগেভাগে ফিরে গেলে ভারত জিতত না, বুক ঠুকে কে বলতে পারে?
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ভবিষ্যতে ডিআরএসের পক্ষে সওয়াল করবেন কি না, সময় বলবে। তবে রবিবার ভারত হারলেও তিনি নিজে কিন্তু দু’টো ‘ম্যাচ’ জিতে থাকলেন। একটা দেশজোড়া তাঁর সমালোচকদের বিরুদ্ধে। অন্যটা টিমে নিজের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’দের বিরুদ্ধে। |
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি |
আমাকে বেশ কিছু দিন ধরে পাঞ্চিং ব্যাগ বানানো হচ্ছে। ভালই। তাতে টিমের বাকিদের উপর চাপ কমবে। দলে এ রকম কয়েকটা পাঞ্চিং ব্যাগ দরকার হয়। সচিন আগে এ ভাবেই দলের সব টেনশন নিজের কাঁধে নিত। আমি মনে করি সকলে এই পাঞ্চিং ব্যাগ হতে পারে না। আমার দলের হয়ে তাই টেনশনের পাহাড় বহন করতে পেরে আমি খুশি। |
|
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মানে তিনজন। বীরেন্দ্র সহবাগ, গৌতম গম্ভীর এবং বিরাট কোহলি। ক্রিকেটমহল হালফিলে ধোনির অবস্থা দেখে এই তিনের মধ্যে যে কোনও একজনকে অধিনায়ক দেখতে চাইছিল। কিন্তু রবিবার এঁদের যা হাল, তাতে আলোচনাটা কিছু দিন বন্ধ থাকবে। নমুনা চাই?
সহবাগ: ১১ বলে ৪। জুনায়েদ খানের লেংথ ডেলিভারি পড়ে ভিতরে ঢুকল। লাইন মিস করে বীরু বোল্ড।
গম্ভীর: বোল্ডের ধরনধারণ সহবাগের মতোই। ঘাতকের নাম শুধু মহম্মদ ইরফান। ১৭ বলে ৮।
কোহলি: দুই পূর্বসুরির মিডল স্টাম্প ছিটকেছিল, তাঁর গেল অফ। জুনায়েদের ফুল-লেংথ ডেলিভারি পড়ে সেই ভিতরে গোঁত্তা খেল, আর ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক ফিরলেন পাঁচ বল খেলে। অবদান? বিগ জিরো! এ দিন তো আবার বল করার সময় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে চোটও পেলেন। রাতে ভারতীয় বোর্ড থেকে জানানো হল, ইডেনে কোহলি খেলবেন কিনা, তা দু’এক দিনের মধ্যে জানানো হবে।
সুইং বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা আধুনিক ব্যাপার নয়। সাবেকি। কিন্তু আগে বিদেশের মাঠে বল নড়লে উইকেট নড়ত, এখন দেশের মাঠেও নড়ছে! চেন্নাইয়ের মেঘলা আকাশ, উইকেটের ভেজা ভাবকে কাজে লাগিয়ে টপ অর্ডারের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন জুনায়েদ। আট ওভারের মধ্যে প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যান হাওয়া, চারজন স্রেফ বোল্ড, স্কোরবোর্ডে উঠেছে মোটে ২৯, কমেন্ট্রি বক্সে রবি শাস্ত্রী বলে চলেছেন, ‘‘সচিন আজ থাকলে মিডল অর্ডার এ ভাবে শেষ হয়ে যেত না।’’
বিশেষজ্ঞদের গালিগালাজ, চিপক গ্যালারির দিনভর ‘সচিন...সচিন’ চিৎকারের ডেসিবেল আরও বাড়ত ক্যাপ্টেন কুল নিজের ক্রিকেটজীবনের অন্যতম সেরা ইনিংসটা আজ না খেললে। বিপর্যয়ের সামনে পাঁচিল তোলার মতো ওস্তাদি টেকনিক তাঁর নেই। আছে বুকের খাঁচাটা। সোজা হিসেবে, ধোনির সেঞ্চুরি না থাকলে ভারত রবিবার একশো পেরোয় না, ম্যাচও অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়। ৭টা বাউন্ডারি, তিনটে ছয় নিয়ে ১২৫ বলে ১১৩ নটআউট। ন’নম্বর ওভার থেকে টানলেন একেবারে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এগুলো নয়, আশ্চর্যের হচ্ছে ধোনি প্রথম বাউন্ডারিটা মারলেন ৭৯ বল খেলে! আজ তাঁকে দেখে একটা সময় পর্যন্ত মনে হয়েছে দ্রাবিড়ের দ্বিতীয় সংস্করণ। ধ্বংস নয়, এ দিন যাঁর মন ছিল সৃষ্টিতে। হেলিকপ্টার শট, ‘কিলার পুল’, টেনিসের ফোরহ্যান্ড ধাঁচের একটা শট, সাত ফুটের ইরফানকে বিশাল ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি সবই বেরোল, তবে শেষে। পরে ধোনি বলছিলেন, “২২৭ খুব কম হয়ে গেল। উইকেটটা সহজ হয়ে গেল পরে।”
ঘটনা। ২২৭ দিয়ে বিপক্ষকে বাঁধতে গেলে ভাল ফিল্ডিং লাগে। লাগে ভাল বোলিং। দু’টোর কোনওটাই আজ ঠিকঠাক হয়নি। ক্যাচ পড়েছে, বোলাররা শর্ট ফেলেছেন, সঙ্গে জুড়েছে জঘন্য আম্পায়ারিং। তবু যদি ইডেনে ভারত ছিটেফোঁটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঢোকে, তা হলে তার রসদ নেবে ক্যাপ্টেনের কালজয়ী ইনিংস থেকে। তা সে হালফিলে যতই ক্রিকেটমহলের পছন্দের ‘পাঞ্চিং ব্যাগের’ নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হোক না কেন!
|
ভারত |
গম্ভীর বো ইরফান ৮
সহবাগ বো জুনায়েদ ৪
বিরাট বো জুনায়েদ ০
যুবরাজ বো জুনায়েদ ২
রোহিত ক হাফিজ বো জুনায়েদ ৪
রায়না বো হাফিজ ৪৩
ধোনি ন.আ. ১১৩
অশ্বিন ন.আ. ৩১
অতিরিক্ত ২২
মোট (৫০ ওভারে) ২২৭-৬।
পতন: ১৭, ১৭, ১৯, ২০, ২৯, ১০২।
বোলিং: ইরফান ৯-২-৫৮-১, জুনায়েদ ৯-১-৪৩-৪, গুল ৮-০-৩৮-০,
আজমল ১০-১-৪২-০, হাফিজ ১০-২-২৬-১, শোয়েব ৪-০-৯-০।
|
পাকিস্তান |
হাফিজ বো ভুবনেশ্বর ০
জামশেদ ন.আ. ১০১
আজহার ক রোহিত বো ভুবনেশ্বর ৫৮
ইউনিস ক অশ্বিন বো দিন্দা ৫৮
মিসবা বো ইশান্ত ১৬
শোয়েব ন.আ. ৩৪
অতিরিক্ত ১০
মোট (৪৮.১ ওভারে) ২২৮-৪।
পতন: ০, ২১, ১৩৩, ১৭২।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৯-৩-২৭-২, ইশান্ত ১০-০-৩৯-১, দিন্দা ৯.১-০-৪৫-১,
অশ্বিন ১০-০-৩৪-০, যুবরাজ ৫-০-৩৩-০, রায়না ২.১-০-২৩-০, বিরাট ২.৫-০-২১-০। |
|
|
|
|
|
|
|