তিন বছরেও শেষ হল না আঠেরো মাসের কাজ
এখনও আঁধারে ৫৬ হাজার পরিবার
গেই নির্ধারিত ১৮ মাসের মধ্যেও রাজীব গাঁধী বিদ্যুদয়নের কাজ সর্ম্পূণ হয়নি বীরভূমে। এমনকী বর্ধিত সময়সীমার মধ্যেও ওই প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করা যাবে না বলেই মনে করছে জেলা প্রশাসনের একাংশ। এর ফলে অন্ধকারেই দিন কাটাতে হচ্ছে হাজার হাজার বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারকে। শুধু তাঁরাই নন, ওই প্রকল্পের কাজ এমন ঢিমেতালে চলায় অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন টাকা দিয়ে সংযোগ নিতে ইচ্ছুক এপিএল তালিকাভুক্ত অসংখ্য পরিবারও।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিপিএল পরিবার বিনা খরচে একটি এগারো ওয়াটের বাতি জ্বালানোর সংযোগ পাবেন। সেই লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বীরভূমের জন্য ১৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ‘প্যাকেজ ১৬’, ‘প্যাকেজ ১৭’ ও ‘প্যাকেজ ১৮’ এই তিন ভাগে জেলার ১৯টি ব্লকে ওই প্রকল্প রূপায়ণের বরাত দেওয়া হয় তিনটি ঠিকাদার সংস্থাকে। ওই বছরই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আঠেরো মাস সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি হয় প্রশাসনের। কিন্তু নির্ধারিত আঠেরো মাসে ওই প্রকল্পের তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি বলেই অভিযোগ। এ ছাড়া মাঝে লোকসভা নির্বাচন এসে পড়ায় প্রকল্পের কাজের গতিও কমে আসে। পরে চলতি বছরের (২০১২) ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ওই প্রকল্পের সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়।
কিন্তু বর্ধিত সময়েও বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছল না নির্ধারিত বিপিএল ও এপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারগুলির সবার কাছে।

রাজীব গাঁধী বিদ্যুদয়ন প্রকল্পে পড়েছে খুঁটি। বিদ্যুৎ আসবে কবে? ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ওই প্রকল্পে ২০০৯ সালে ২,০৮৮টি গ্রামে বিদ্যুদয়নের কাজ অনুমোদিত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে অন্য প্রকল্পে বিদ্যুদয়ন হয়ে যাওয়া এবং নানা জটিলতার জন্য ২,০০৭টি গ্রামে বিদ্যুদয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়। বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা ১,৭৫,০৫৮টি পরিবারের। কিন্তু প্রশাসনেরই হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বিদ্যুদয়নের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে মাত্র ১,৬৫১টি গ্রামে। তার মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা গিয়েছে মাত্র ১,৪৭০টি গ্রামে। সংযোগ পেয়েছেন মোট ১,১৮,৮৮৮টি পরিবার। খরচ হয়ে গিয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কিন্তু ওই হিসেবই বলছে এখনও অন্ধকারে রয়েছেন ৫৬,১৭০টি পরিবার। বর্ধিত সময় অর্থাৎ এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেও বীরভূমের প্রতিটি বিপিএল ভুক্ত পরিবারে যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া যাবে না তা মেনে নিচ্ছেন প্রশাসনেরই একাংশ।
ওই প্রকল্পেই প্রায় দু’ বছর আগে বিদ্যুদয়নের জন্য খুঁটি পোতা হয় লাভপুরের লায়েকপুর গ্রামে। কিন্তু আজও অবধি বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি সেখানে। অভিযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়ায় অন্ধকারে রয়েছেন ওই গ্রামের বিপিএল তালিকাভুক্ত ৫০টি পরিবার। ওই গ্রামের তুলসী দাস, ভারতী বিত্তার-রা বলেন, “দু’ বছর ধরে শুধু খুঁটি পোতাই দেখছি। ঘরে আলো কবে জ্বলবে জানি না।” এমনকী টাকা দিয়ে সংযোগ নিতে ইচ্ছুকদের মধ্যে একজন কাশীনাথ হাজরা বলেন, “টাকা দিয়ে সংযোগ নেওয়ার জন্য স্থানীয় বিদ্যুৎ দফতরে আবেদন করি। কিন্তু বিদ্যুৎ দফতর পরিদর্শন করে প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় সংযোগ দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।”
একই ভাবে অন্ধকারে রয়েছেন রামপুরহাট থানা এলাকার বড়গাছিয়া, নুরাইতলা, বড়পাহাড়ি, নতুনপাড়া প্রভৃতি গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারও। বছর খানেক আগে খুঁটি পোতা হলেও বিদ্যুতের তারই টানা হয়নি সেখানে। আবার কোথাও অন্যান্য কাজ সম্পূর্ণ হলেও দেওয়া হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। বড়গাছিয়ার মিনু মাড্ডি, সোম সোরেন, বড়পাহাড়ির রাবণ মুর্মুরা বলেন, “ঠিকাদার সংস্থার লোকেরা বিদ্যুৎ সংযোগ করার জন্য এখন আবার টাকা চাইছে। টাকা দিয়েই যদি সংযোগ নেওয়ার সামর্থ্য থাকত, তাহলে তো আগেই নিয়ে নিতাম! কেউ কি স্বেচ্ছায় অন্ধকারে থাকে?”
এত দিনেও কেন প্রকল্পের কাজ শেষ করা গেল না?
প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দীঘর্সূত্রিতার পিছনে অনেকগুলি কারণ উঠে আসছে। ঠিকাদার সংস্থা তথা প্রশাসনের কিছু কর্মীর অসাধু যোগসাজশ, রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা থেকে স্থানীয় বাধা সব মিলিয়ে জটিলতা হয়েছে প্রকল্প রূপায়ণে। বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা, বাড়ির কাছে খুঁটি বসিয়ে নেওয়া বা কৃষি-বাণিজ্যিক সংযোগ নেওয়া সব ক্ষেত্রেই টাকা নিয়ে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে। যার জেরে দিনের পর দিন আটকে গিয়েছে প্রকল্প রূপায়ণের কাজ। আবার কোথাও সমীক্ষার সময়ে গ্রামবাসীদের অন্ধকারে রেখে কাজ করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে প্রশাসন। সর্বোপরি রয়েছে ‘রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা’। প্রকল্প শুরু হওয়ার সময় ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের সংযোগ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সমীক্ষকদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয় বলেও অভিযোগ। পরবর্তী কালে রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয়। ক্ষমতা বদল হয় বহু পঞ্চায়েতেও। প্রকল্প রূপায়ণকারী সংস্থার এক আধিকারিক বলেন, “সমীক্ষা অনুযায়ী এলাকাগুলিতে কাজ করতে গিয়ে আমাদের নতুন করে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।” ফলে দিনের পর দিন আটকে থাকছে এমন একটি জরুরি প্রকল্প রূপায়ণের কাজ।
তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান তথা রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “সিপিএম সমীক্ষকদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোকেদের সংযোগ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন তা সামনে এসে পড়ায় প্রকল্প রূপায়ণে বিলম্ব হচ্ছে।” সেই অভিযোগ অস্বীকার করে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূলের মতো সঙ্কীর্ণ রাজনীতি আমরা করি না।” ওই প্রকল্পের জেলা আধিকারিক বিশ্বজিৎ বাগদি অবশ্য বলেন, “গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে আলোচনা করেই সমীক্ষার কাজ করা হয়েছিল। মূলত স্থানীয় বাধার কারণেই বিভিন্ন জায়গায় প্রকল্প রূপায়ণের কাজ আটকে রয়েছে। তা ছাড়া আইনি জটিলতার কারণেও একটি প্যাকেজের কাজ দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। আলোচনার করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে।” এ ছাড়া তাঁর দাবি, আর্থিক দুর্নীতির দায়ে ইতিমধ্যেই একটি সংস্থাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “তার মধ্যে যাঁরা সংযোগ পাওয়ার পেয়ে যাবেন, বাকিদের জন্য কিছু বলা যাচ্ছে না।” তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্রান্ট’-এর তহবিল থেকে সম্প্রতি ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ৯৯৩টি গ্রামে সমীক্ষার কাজও হয়ে গিয়েছে। ওই প্রকল্প রূপায়িত হয়ে গেলে আর কোনও পরিবারকে অন্ধকারে থাকতে হবে না বলেই তাঁর আশ্বাস।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.