দক্ষিণেশ্বর
সাজবদল
চেনা ছবিটাই যেন বদলে গিয়েছে!
রাস্তার দু’ধারের দোকান ও হকারেরা এখন আর নেই। বদলে সেখানে এখন সুন্দর বাতিস্তম্ভ, গাছের সারি। আগাছার জঙ্গল সাফ করে সেখানে তৈরি হয়েছে বাগান ও পার্ক। গঙ্গার পাড়ে বাঁধানো রেলিং। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির চত্বরে।
দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাছে মন্দিরকে আরও সুন্দর করে তুলতে কয়েক বছর আগে থেকেই এ রকম বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা নেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও দেবোত্তর এস্টেট কর্তৃপক্ষ। মন্দির কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, কেএমডিএ-র কারিগরি সহায়তায় দক্ষিণেশ্বরের আদি ও অকৃত্রিম পরিবেশ পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও পুরনো স্থাপত্যগুলিকে সংরক্ষণ করে মন্দির চত্বরের সৌন্দর্যায়নের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এ কাজের জন্য খরচ হয়েছে প্রায় আট কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মিলেছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ টাকা।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির চত্বরের বদলটা শুরু হয়েছে মন্দিরের সিংহদুয়ার (বিবেকানন্দ তোরণ) থেকে। আগে এই মূল দরজার সামনে থেকেই প্রায় কুঠিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে শাঁখা, ছবি, পাথরের জিনিস, পুজোর প্রসাদের দোকান ভর্তি ছিল। ফলে ঘিঞ্জি রাস্তায় এক সঙ্গে বেশি দর্শনার্থী চলতে পারতেন না। গাড়ি রাখার জায়গা নিয়েও ছিল সমস্যা। বিশেষ কোনও উত্‌সবের দিন তা আরও ভয়াবহ আকার নিত। এখন সিংহদুয়ার থেকে কুঠিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে পার্কিংয়ের তিনটি জায়গা। আবার সিংহদুয়ারের পাশেই রাস্তার ডান দিকে একটি পাঁচ তলা খাবার জায়গা ও অতিথি নিবাস তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির দেবোত্তর এস্টেটের পক্ষে কুশল চৌধুরী। তিনি বলেন, “বহু দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। অনেকে মন্দির চত্বরেই থাকতে চান। এটা তৈরি হলে তা সম্ভব হবে।’’ রাস্তার দু’পাশ থেকে পুজোর প্রসাদ, অন্যান্য সামগ্রীর দোকান সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যত্র। তৈরি হয়েছে ডালা আর্কেড ও পণ্য বিপণি।
সিংহদুয়ার থেকে ঢুকেই রাস্তার বাঁ দিকে দুধপুকুর এলাকা। আগে এখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারতেন না। এখন পুকুর সংস্কার করে চারধারে বাহারি আলো লাগিয়ে শিশুদের জন্য তৈরি হয়েছে রানি রাসমণি উদ্যান। কুশলবাবু জানান, দুধপুকুর সংলগ্ন গাজি পীরের সমাধিস্থলটি ও বেলতলা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘কেএমডিএ-র কারিগরি সহয়তায় পুরো মন্দির চত্বরের সংস্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্থাপত্যগুলিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।’’
২০০২ সালে গঙ্গার পাড়ের ভাঙনে দক্ষিণেশ্বরের ১২টি শিবমন্দিরে ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে কেএমডিএ-র কাছে সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য সেই পাড় সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে। মিলেনিয়াম পার্কের ধাঁচে গঙ্গার ধারে কংক্রিটের রেলিং দেওয়া হয়েছে। দর্শনার্থীদের কথায়, কয়েক দিন আগে পর্যন্ত গঙ্গার পাড় ঘেঁষা ফাঁকা জায়গায় খাবার, খেলনা, ছবি নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে অস্থায়ী দোকানদারেরা বসতেন। কিন্তু মন্দিরের সৌন্দর্যায়নের ফলে তাঁদের ওই জায়গা থেকে তুলে পাশের একটি ঘেরা জায়গায় এক সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই জায়গাতেই রয়েছে পঞ্চবটী উদ্যান ও শান্তিকুঠি। কয়েক বছর আগে সেটিকেও সংস্কার করে নতুন ভাবে সাজানো হয়েছে। প্রতি দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা ও বিকেল সাড়ে ৩টে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পঞ্চবটী উদ্যান দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকছে। বর্ধমান থেকে সপরিবার দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন সম্রাট নস্কর। তাঁর কথায়: “বেশ ক’বছর পরে এলাম। চিনতেই পারছিলাম না। পুরো পাল্টে গিয়েছে।”
যে কুঠিবাড়ির সামনে পূজার সামগ্রীর দোকানপাট থাকায় সব সময় ভিড় লেগে থাকতো, সেখানকার ছবিটাও পুরো পাল্টে গিয়েছে। বাড়িটির পুরনো নকশা বজায় রেখেই সংস্কার করা হয়েছে। জানা যায়, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের সময় রানি রাসমণি ওই বাড়িতে থেকেই নির্মাণের তদারকি করতেন। ১৮৫৫ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ ওই কুঠিবাড়িতেই থাকতেন। ঐতিহাসিক সেই বাড়িটি সংস্কারের পরে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি গ্রন্থাগার। এখানে ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে পাঠ্যবইও। প্রতি দিন সকাল সাড়ে ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা থাকে। কুঠিবাড়ি এলাকায় চলার পথে বসানো হয়েছে দামি পাথর, রাস্তার ধারে লাগানো হয়েছে বাহারি বাতিস্তম্ভ ও গাছ। কয়েক মাস আগে এই কুঠিবাড়ির পাশেই নারকেল গাছ ঘেরা একটি জায়গায় স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি স্থাপন করা হয়। উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিরাপত্তা জোরদার করতে কুঠিবাড়ি এলাকাতেই তৈরি হয়েছে দক্ষিণেশ্বর ফাঁড়ির নিজস্ব বাড়ি। পুরো মন্দির চত্বরে লাগানো হয়েছে ক্লোজ্ড সার্কিট টিভি। রয়েছে বেসরকারি নিরাপত্তা। এ ছাড়া ঝাউতলায় ধ্যানভবন নির্মাণ, রানি রাসমণির মূর্তি স্থাপন, শ্রীমার ঘাট (বকুলতলা ঘাট), কেন্দ্রীয় ঘাট (চাঁদনি ঘাট), নতুন পার্কিং জোন, শৌচালয়, বাগান তৈরি করা হয়েছে।
তবে মন্দির চত্বরের বাইরের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের সামনে থেকে সিংহদুয়ার পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে দোকান, হকার থাকায় রাস্তা ক্রমশ ঘিঞ্জি হয়েছে। তার সঙ্গে বাড়ছে গাড়ির চাপ। দর্শনার্থীদের কথায়, ক্রেতা, গাড়ির জটে মিনিট পাঁচেকের পথ যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। কুশলবাবু বলেন, “বাইরের রাস্তার দায়িত্ব আমাদের নয়। কিন্তু ওই রাস্তার সমস্যা না মিটলে সৌন্দর্যায়ন পুরো হবে না।” পরিবহণমন্ত্রী তথা স্থানীয় বিধায়ক তৃণমূলের মদন মিত্র বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ওই রাস্তায় সাবওয়ে তৈরির জন্য বলেছিলেন। কেএমডিএ-র ইঞ্জিনিয়াররা দেখছেন, কী ভাবে তা করা যায়। দোকানগুলি রাস্তার উপরে চলে আসায় সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা মেটাতে ভাবনাচিন্তা চলছে।”

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.