প্রবন্ধ...
ওয়েলকাম টু নরক
ড়দিন এল। শান্তিও মরল। শহরের বাছাই কিছু খোপ, একটা সপ্তাহের জন্য আবার নরক হয়ে গেল। গ্যারান্টি। ওরা আছে না? ওদের সাফ সাফ হিসেব পুজোর সময় দু’ঘণ্টা লাইন দিয়ে চাইনিজ খেতে হয়, কেকেআর জিতলেই শাহরুখ খানের ছবিতে মালা ঝুলিয়ে নাচতে হয়, আর ক্রিসমাস নিউ ইয়ার এলেই পার্টি করতে হয়। লাস্ট একটা উইক ওরা ফ্যান্সি দোকানে চকচকে জামার খোঁজ নিয়েছে, জুতোয় পালিশ বুলিয়েছে আর নখ-দাঁত শানিয়েছে। শিকার ধরতে হবে না? সন্ধে দু’টোয় ঘড়িতে যখন ঢংঢং করে আটটা বাজবে, কলকাতায় যম নামবে। ওরা তখন খ্যাতিবহুল ও মরসুমি ডিস্কোথেকের দরজায় রাস্তায় থিকথিক। নিউ ইয়ার ব্লাস্ট-এর পাস দিয়ে হাওয়া খাচ্ছে। আমি কী আপমার্কেট দ্যাখ্, আমি থাট্টিফাস্টের পাস পাই, আমি ডিস্কে যাই। এরা একা ছেলেদের ঢুকতে দিচ্ছে না? চাপ নিয়ো না। পকেটে কড়কড়ে দশ হাজার দিয়ে কেনা জন্নতের টিকিট। সেখানে যেতে আজ আমিই ভরসা, তাই আমি রাজা, আমি সলমন খান। তা হলে মেয়ের অভাব কীসে? ওরাও তো যেনতেনপ্রকারেণ ক্লাবে ঢুকবে বলে ক্যাটরিনা কাইফ সেজে এসেছে। সুতরাং পরিচয়শুরুর শিষ্টাচারকে গুলি মেরে, গ্রামারের শ্রাদ্ধ ইংরেজিতে ওদের সঙ্গে আলাপ করাই যায়। ইউ ওয়ান্ট পাস? কাম উইদ আস। ইয়েস ইয়েস প্রমিস প্রমিস। নো ইন্টার্যাকশন ইনসাইড।
কেয়া বাত আজ কি রাত! রাস্তায় যারা আমাদের দেখতেই পায় না, একসঙ্গে ডিস্কে ঢুকল! আরে, এটা প্যারাডাইস, ঢুকলেই রম্ভা মেনকারা ঘিরে ধরবে! বিদেশেও এমনই পার্টি হয়, ছেলেমেয়েরা খোলামেলা মেশে। এখানে এক বার ঢুকতে পারলেই সেই বিদেশে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখানে মেয়েদের পাওয়া তীব্রতম সহজ। একটা মেয়ে এখানে আসে, ড্রিঙ্ক করে, মানেই চিন্তাহীন, বাছবিচারবিহীন। তাই ওদের দিকে তাকালেই বিগলিত হয়, কথা ছুড়লে দারুণ খুশি। যে ট্রেন্ড ডান্সাররা আরবি নাচ-এর শো করছে আর যে মেয়েটা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এসেছে, তারা সবাই তোর-আমার সম্পর্কে আইটেম গার্ল হয়। এদের মুন্নি-শীলা জ্ঞানে ঘিরে ধরে নাচতে হয়, কিম্ভূততম আচরণে চমকিত, আতঙ্কিত করে আপন অস্তিত্ব জানান দিতে হয়। সেটাকেই এনজয় বলে। পার্টি মরসুমে ওই ক্লাবঘরে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। তাই তো পয়সা জমিয়ে এই সময়ে এখানে আসা। ওহ্ কী হুক্কাহুয়া আনন্দ রে! ভেতরের এক চিলতেয় ধোঁয়া আর অন্ধকার ঘনাচ্ছে। মুড়ির কৌটোর মতো ভিড়। হাঁউমাঁউখাঁউ করে অনভ্যাসে নাচতে গিয়ে অন্যের পা মাড়িয়ে দিচ্ছে। বারটেন্ডাররা পানীয়ে আগুন ধরাচ্ছে দেখে এক্সাইটমেন্টে ঘি। উল্লাস, উৎসব, ফরেন, ওপেন রিলেশনশিপ, জীবন। সিলিং থেকে অবশ্য দেখাচ্ছে: অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড, তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড!
ছবি: সুমন চৌধুরী
ডিজে-ও গরম হলে হিন্দি বাজায়। রাত বাকি বাত বাকি। এত ক্ষণে জমেছে, শ্যাম্পেন ছিটিয়ে জামা ভিজিয়ে পাশের জনকে জবরদস্তি মস্তির শরিক করো। বচ্ছরকার দিন, কিছু বলবে না। বিন্দাস পরিবেশ, জিন শেরি শ্যাম্পেন-এ শরীর সমুদ্দুর, মাথাটা টালমাটাল। ধুর, এতে হয় নাকি? স্পেশাল সিগারেট চাই, পানীয়ে লুকিয়ে জোগাড় করা সাদা গুঁড়ো মেশাও, দু’তিনটে পাঞ্চ করে দাও। একটাই তো দিন। এনজয়।
তার পর কী হইল জানে শ্যামলাল। ডিস্কোগুলোর আসবাব শ্যামলাল, ডিস্কোগুলোর ইন্টিরিয়র শ্যামলাল। তাদের রোজের চেনা লোকরা তো এ ক’দিন আসে না। এক্সক্লুসিভ ক্লাব কিংবা বন্ধুর বাড়ি খুঁজে নেয়। আসে ওরা। আর ওদের দেখে আসবাব-পর্দা, ইন্টিরিয়র, ডিস্ককর্মীদের চোখ ঠিকরে বেরোয়, বাক্ রুদ্ধ। দেখে, কাউন্টডাউন করে বড়দিন, নতুন বছর নামছে, সঙ্গে একটা বীভৎস চাকা পার্টি-কাস্টমারদের পিষতে পিষতে এগোচ্ছে। কাটা কলাগাছের মতো চেয়ার উল্টে বোতল, কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ছে। আয়না মেঝেতে থইথই বমি, অভিজাত হোটেলটা দেখতে দেখতে পোড়া শ্মশান। ওই মেয়েগুলোই সঙ্গে ঢুকেছিল। অর্থাৎ নতুন বন্ধু। ‘ডান্স’? যাব্বাবা, বন্ধুরা মুখ ঘোরাল কেন? আচ্ছা, কমলালেবুর রস অফার করা যাক ওদের, আনার সময় নিজে হাতে করে পাউডার মিশিয়ে দিলেই হবে। তার পর সেন্সরা চূর্ণবিচূর্ণ, সব কালো গেঞ্জিকেই ইয়ার-দোস্ত মনে করবে। তারা বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইলে, রাতের কলকাতায় কার রেস-এ নিয়ে যেতে চাইলে, না করার কথা মাথাতেই আসবে না। চাইলেই বা এখান থেকে একা বেরোবে কী করে? পার্টিজোনের আশপাশ, চৌহদ্দিও এখন পাগলাগারদ। যারা ঢুকতে পারেনি, সামনের ফুটপাথেই ‘ম্যা তেরা হির্রো’ বলে দাপাচ্ছে, টেম্পোতে স্টিরিয়ো বসিয়ে শহর ঘুরছে, মেয়ে দেখলে ‘মেরি ক্রিসমাস’ গোলাপ ছুড়ছে। ট্যাক্সিঅলাও ওত পেতে। একা মেয়ে, এক গ্রুপ মেয়ে, কাপ্ল, যে উঠবে কলকাতা-হাওড়া বনবন ঘুরিয়ে, গন্তব্যের এক মাইল দূরে, খাঁখাঁ রাস্তায় নামিয়ে দেবে। ‘পার্টি’ করার হক আমারও আছে বস।
ডিস্কোপট্টিতে আসর ভেঙেছে। নতুন বছরের প্রথম সকাল হচ্ছে একটু একটু করে। কল্লোলিনী তিলোত্তমা হাহাকার করে কাঁদছে। কে তার শরীরে সাবালক কথাটা আঁচড়ে লিখে দাগড়া করে দিয়েছে। পাঁচতারার টয়লেটে গাদাগাদি পড়ে তার সন্তানের দল, স্ববর্জ্যে মাখামাখি। ডিস্কের সোফায় সতেরো ডিগ্রি সেলসিয়াসে খালি গায়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে হ্যাংওভার-আক্রান্ত যুবক। জামা, সোনার চেন, মোটা পার্স, স্মার্টফোন এখন মহাশূন্যে। কেউ রাস্তার বুকেই চপচপে রক্ত মেখে শুয়ে। নেশার চোটে ব্যথা টের পায়নি। কে জানে ও আর কোনও দিনও বাড়ি যাবে কি না!
ডাক্তার ‘সেভেন্টি টু আওয়ারস’ বলবেন, আবছা করা ছবিতে এক মা বা বোন হড়হড় করে কাঁদবেন। কত জন মোমবাতি নিয়ে হাঁটবে, ফাঁসির দড়ির ছবি শেয়ার করবে। মাথারাও বেলাইনে ভেবেই খেঁকাবেন, ‘জানে তো ওখানে ওই সব হয়, মেয়েটাও খারাপ। না হলে যায় কেন?’
ওরা কেন এ রকম? ওরা খারাপ? উচ্ছন্নে যাওয়া? হান্ড্রেড পার্সেন্ট ইররেসপনসিবল? ভ্যালুজ বলে কিস্সু নেই? সব ঠিক। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু ঠিক আছে। ওদের সব গুলিয়ে, ঘেঁটে গেছে। বিদেশ কী ভাবে জীবন চাখে, ওদের কানে ভেসে আসে, ফিল্মে অল্পস্বল্প ঝলক দ্যাখে। কিন্তু ওদের আধা শিক্ষা, চার দেওয়ালি দুনিয়া, লাস ভেগাসের পুরো একশো আশি ডিগ্রি উল্টো পৃথিবীতে বাস করা ঘর-পরিবার। সব মিলিয়ে এই ফ্রি সোসাইটির কেসটা কিছুতে ঠাওর হয় না। লোভ হয়, আর কেঠো মগজে সবটা তালগোল পাকিয়ে যায়। জন্মায় একটা অষ্টাবক্র মন। ওরা শোনে ‘ওপেন রিলেশনশিপ’, মানে বোঝে অপরিচিতের গায়ে হামলে পড়া, তাকে ডিসটার্ব করা। ওটাই ওদের আনন্দ। বছরশেষে দিকে দিকে নাচগানের আমন্ত্রণ দেখে মগজটা আরও খেপে ওঠে। সোজা কথা হল, একটা সম্পূর্ণ অযোগ্য সমাজ পার্টি করতে বেরিয়ে পড়ে। ফল? জাহান্নাম। যেখানে প্রাইভেট ঘরে গ্রুপ সেক্স আর পাবলিক বাসে গ্যাং রেপ-এর মধ্যে কোনও প্রভেদ বাঁচে না।
এ ভাবেই আজকাল এখানে প্রতি বার নতুন বছর আসে। কান্নাভেজা পূতিগন্ধপূর্ণ ডিপ্রেসড ছত্রভঙ্গ কাকচিলওড়া এক শেষের সকালে, ওরা পরস্পরকে হ্যাপি নিউ ইয়ার উইশ করে। দিলওয়ালো কা দিল্লি এবং কল্লোলিনী কলিকাতা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.