|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনায় অনেক নিরীহ মানুষের ওপর যে চরম দুর্গতি নেমে এল সে জন্য আমিও যন্ত্রণা পেয়েছি। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের মাধ্যমে সেই যন্ত্রণা আমি প্রকাশও করি, তবে একটু...’ এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ থেমে গেলেন মানুষটি, যাঁকে আমি জার্মান বেতারের হয়ে একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সেই প্রথম অত কাছ থেকে দেখছি। জার্মানির কোলন শহরের একটি পাঁচতারা হোটেলের ঘর। ১৯৮৮ সাল। ভুরু কুঁচকে একটু ভাবলেন। তার পর মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, সাট্ল-এর বাংলা কী?’ ‘সূক্ষ্ম’ কথাটা বলার জন্য আমার ঠোঁট দুটো ছুঁচলো হওয়া মাত্র উনি সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘সূক্ষ্ম’। ‘সেই যন্ত্রণা আমি প্রকাশ করি সূক্ষ্ম ভাবে। এদের দেশে হয়তো বাজনার সাহায্যে গ্যাস বেরনোর আওয়াজটা করে দেওয়া হত। আমরা ওই ভাবে সঙ্গীত করি না। ওই ধরনের ঘটনা আমাদের ওপরেও ছায়া ফেলে। আমাদের সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকাশও করি। কিন্তু তার পথটা আলাদা।’
পথ আলাদা হলেও সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-র থিম শুনে আমি উদাস হয়ে যেতে দেখেছি ইউরোপীয়দের, আমেরিকানদেরও। কথা বলে দেখেছি অনেকেই এমন এক বেদনা অনুভব করেছেন যার ব্যাখ্যা তাঁদের জানা নেই। সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্করের তৈরি অলোকনাথ দে-র বাঁশিতে বাজানো সেই সুর, যার মধ্যে ঘোষিত বিষাদ নেই অথচ যা বুকে এসে লাগে। পা, শুদ্ধ ধা, তার সপ্তকের সা, শুদ্ধ ধা, শুদ্ধ মধ্যম, শুদ্ধ ধৈবত, পঞ্চম এই পরম্পরায় সেই সুর। তার সপ্তকের সা ছাড়া সবক’টি স্বর মধ্য সপ্তকে। সব ক’টি শুদ্ধ। বিষণ্ণতার ছোঁয়া এনে দিতে পারে এমন কোমল স্বরের প্রয়োগ নেই। অথচ এই সুর দুঃখের দোসর। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
বাংলা পল্লিসুরে কোমল নিখাদের প্রয়োগ কোত্থেকে এক ফোঁটা দুঃখ নিয়ে আসে। খুব কম সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক খামাজ ঠাট এড়িয়ে, অর্থাৎ শুদ্ধ রে, গা, মা, ধা ও কোমল নি’র প্রয়োগ না করে পল্লিবাংলার সুরাবহ রচনা করতে চেষ্টা করেছেন। ‘পথের পাঁচালী’-র সঙ্গীত পরিচালক ব্যতিক্রম। তাঁর তৈরি থিমে নি শুদ্ধ। সম্ভবত এরই ফলে গোটা মেজাজটায় দুঃখের পরিচিত উপাদানটি নেই। ‘পথের পাঁচালী’র বাঁশির সুর অভাব, দুঃখ, শোক বা ট্র্যাজেডি-র প্রতিনিধি হতে নারাজ। বরং সেই সুর যেন বিয়োগব্যথাকে মেনে নিয়েই চলমান জীবনে শামিল হতে চাইছে। এই চাওয়ার প্রকৃতি শান্ত। প্রশ্ন হল, শান্ত ভাবটি কি দুঃখ বা বিষাদকে ঢেকে দিতে পারছে? যদি পারত তা হলে ‘পথের পাঁচালী’র থিম শুনে সংবেদনশীল মানুষের মন উদাস হয়ে যায় বা ব্যথা পায় কেন? ‘পথের পাঁচালী’র টাইট্ল ও থিম মিউজিক আজ নতুন করে শুনতে গিয়ে এই প্রশ্নটিকে একেবারে বাদ দিতে পারছি না। না কি ৯২ বছর বয়সে সদ্যপ্রয়াত সর্বকালের এক সেরা সঙ্গীতশিল্পী যে শূন্যতা রেখে গেলেন তা সইয়ে নেওয়ার একটি উপায় খুঁজছি আমি।
১৯৮৮ সালে কোলন শহরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্কর আমায় বলেছিলেন, ট্র্যাজেডির অনুভব প্রকাশের বেলায় আমাদের পথটা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের থেকে আলাদা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনির ভিত্তিতে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ছবি ‘পথের পাঁচালী’র আবেদন আর যাই হোক সুখকর ও আনন্দদায়ক নয়। ব্যথা তার পরতে পরতে। সেই ব্যথাকে বাদ দিয়ে জীবন হতে পারে না। কিন্তু ব্যথা তো ব্যথাই। ১৯৬২ সালে বাঁশিতে বাড্ শ্যাঙ্ক ও তবলায় কানাই দত্তকে নিয়ে সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্কর ‘ইম্প্রোভাইজেশন্স অন দ্য থিম মিউজিক ফ্রম পথের পাঁচালী’ নামে যে কাজটি করেন (ইউ টিউব-এ এটি যে কেউ শুনতে পারেন) সেটি হয়তো জীবনের বৈচিত্রে ও সামগ্রিকতায় ব্যথার স্থান নির্ণয়ের একটি স্টাডি। প্রথমে, বাঁশিতে নয়, সেতারে ‘পথের পাঁচালী’র থিম। তাল ছাড়া। ছায়াছবিতে বাঁশিতে যে সুর বেজেছিল, সেটাই। হঠাৎ সেতারে সংক্ষিপ্ত তান। বৈচিত্রের প্রথম স্বাদটুকু পেলাম আমরা। নতুন খবর। লক্ষণীয়, ছায়াছবিতে বাঁশিটি বেজেছিল মধ্য সপ্তকে। এই পরিবেশনায় সেতারে প্রথমে মন্দ্রধ্বনি, তার পর মধ্য। এর পর বাঁশিতে একই থিম। পিছনে মন্দ্রসপ্তকে সেতারের হালকা প্রতিধ্বনি যেন। তার পর সেতার স্তব্ধ। সঙ্গে কোনও তালযন্ত্র নেই। এর পরেই কিন্তু থিমটি শোনা যাচ্ছে সেতারে সাত মাত্রায়, দ্রুত লয়ে, যদিও প্রথমে সম্পূর্ণ অন্য সুর। এই জোরালো বৈচিত্র থেকে আমাদের আবার ফেরানো হচ্ছে মূল থিমে। ছায়াছবির থিমে স্পষ্ট করে কোনও তাল ছিল না। কিন্তু ধীর-গতি আট মাত্রার চলনের একটা আভাস ছিল অন্তর্লীন। সেটিকে এ বারে দ্রুতলয় সাত মাত্রা করা হল। এর ফলে এসে পড়ল নৃত্যশীলতা। সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্কর কিন্তু প্রথমে নাচ শিখেছিলেন তাঁর বড় ভাই আচার্য উদয়শঙ্করের কাছে। হয়তো এই কারণেই তাঁর বাজনায় সুর-তাল-ছন্দের এমন এক নৃত্যশীলতা বরাবর লক্ষ করা গিয়েছে যা ওই মাত্রায় অন্য কোনও শিল্পীর বাজনায় শোনা যায়নি। সেতারের সঙ্গে রয়েছে তালযন্ত্র। এখান থেকে আবার বাঁশিতে থিম। এ বারে বাঁশি বাজছে তার সপ্তকে। ফলে ধ্বনিপটভূমির পরিসর যাচ্ছে বেড়ে। পিছনে তারযন্ত্র, মধ্য সপ্তকে। তালহীন। এখান থেকেই বেশ দ্রুত লয়ে সেতার। সুরের ভিতরে থিমটি অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু তাকে ঢেকে রাখছে একই স্বরসমূহ-নির্ভর অন্য একটি সুরের মেজাজ। এর পরেই আবার বাঁশিতে থিম, মধ্য সপ্তকে। পিছনে সেতারের মৃদু গুঞ্জন। এখান থেকে সেতারে ঝালা আঙ্গিকে বাজানো থিম-সওয়ারি সুর। দ্রুতগতি তালযন্ত্র ও পার্কাশান। থিমও কিন্তু স্থান পাচ্ছে সেই দ্রুতলয় ঝালা আঙ্গিকে। এর পর আবার বাঁশিতে থিম। অন্য কোনও যন্ত্র নেই। এখান থেকে সেতারে মন্দ্র ধ্বনিতে একই থিম, সঙ্গে এক টুকরো তানের আভাস। অর্থাৎ যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।
এই পর্বভাগ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি থিমের চরিত্রটিকে সঙ্গীতকার কত রকমের আঙ্গিকগত বৈচিত্রে স্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। লক্ষণীয়, যন্ত্রটি যখন সেতার, তখন থিমের সঙ্গে অন্য সুরের মিশেল ঘটছে। যন্ত্রটি যখন বাঁশি, তখন তা ঘটছে না। ‘পথের পাঁচালী’র থিমটিকে আমরা বাঁশিতেই খাঁটি অবস্থায় পাচ্ছি প্রতি বার। সুর-তাল-লয়ের দিক দিয়ে থিমটিকে বাঁশিতে অপরিবর্তিত রেখে সেতারে যে বৈচিত্রগুলি আনা হয়েছে, তার যে কোনও একটিকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব দিতে পারতেন রবিশঙ্কর, কিন্তু দিলেন না। স্টাডিটি শেষ হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’র মূল থিমেই। কারণ, এটিকে কেন্দ্র করেই তো সুরতালছন্দ ও লয়ের বিচিত্র পরিক্রমা। আর একটি কারণও কিন্তু থাকতে পারে: অভিজ্ঞতার বৈচিত্রে জীবনের অমোঘ ব্যথা, শোক বেশ কিছুটা চাপা পড়ে গেলেও তা মুছে যায় না, থেকেই যায়। কিন্তু এই ভাষ্য আবেগের হিসেবে। এই পাঠ অন্য কেউ না-ও নিতে পারেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই স্টাডিতে ‘পথের পাঁচালী’র থিমটিকে ঘিরে আঙ্গিকের যে বৈচিত্র সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্কর এনেছেন, সেই মুনশিয়ানার জন্যই বিশ্ববাসীকে দখল করতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর বাজনায় এক দিকে ছিল তন্নিষ্ঠ ভাব, আর অন্য দিকে সুর ছন্দ লয়ের বিচিত্র খেলা, যার গতিপ্রকৃতি আগে থেকে আঁচ করা যেত না। ফলে তাঁর বাজনা থেকে-থেকেই নতুন নতুন খবর পৌঁছে দিত। উল্লিখিত স্টাডিতে, যেমন, ‘পথের পাঁচালী’র থিম যে হঠাৎ সাত মাত্রায় অত দ্রুত লয়ে আত্মপ্রকাশ করবে কে জানত। অথবা সেতারসুলভ ঝালায়। |
|
|
|
|
|