শীত শেষে অপেক্ষা করে আছে উপোস, নিদেনপক্ষে আধপেটা তো বটেই!
চেনা খাবার চেপ্টি, পুরন্ডি না হয় মালসা... নাঃ, বনবাদাড় ঢ়ুঁড়েও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। না-ও মিলতে পারে চিনে বাঁশ, হরতুকি কিংবা পেঁপে, চালতা বা বয়রার মতো পছন্দের গাছগাছালিও।
অগত্যা খাবারের খোঁজে বনের চৌকাঠ উজিয়ে লোকালয়ে পা না বাড়িয়ে আর উপায় নেই তৃণভোজীদের। এবং আশঙ্কাটা যে মোটেই অমূলক নয়, বন দফতরের শীর্ষকর্তাদের কথাতেই তা স্পষ্ট “বনে খাবার না পেলে, মাঠের ফসল কিংবা গাঁ-গঞ্জের খামারে হানা দেওয়া ছাড়া ওদের আর উপায় কী!”
কিন্তু বনে-বাদাড়ে খাদ্য সঙ্কটের ইশারা কেন?
উত্তর স্পষ্ট: বন দফতরের ৫৮টি ডিভিশনের অবস্থা প্রায় কপর্দকশূন্য! এতটাই যে চলতি আর্থিক বছরে জঙ্গলে পশু-খাদ্য কার্যত রোপনই করা যায়নি। এক রকম শিকেয় উঠেছে অস্থায়ী কর্মীদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থাও।
অথচ রাজ্য বাজেটে বন দফতরের বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১-১২ আর্থিক বছরে বন বিভাগের বাজেট-বরাদ্দ ছিল ১২৫ কোটি টাকা। এ বার (২০১২-১৩) তা বেড়ে হয়েছে ১৬৩ কোটি। কিন্তু সে তো খাতায়-কলমে। আর্থিক বছরের ন’মাস পেরিয়েছে, বরাদ্দের ২৫ শতাংশ টাকাও খরচ হয়নি! এক শীর্ষ বন কর্তার কটাক্ষ, “টাকা হাতে পেলে তো খরচ করা হবে! নতুন ট্রেজারি আইনের জটে হাতি তাড়াতে পটকা কেনার টাকা পেতেই আঠারো মাস।” ট্রেজারি আইনের ‘জটে’ বনাধিকারিকদের হাতে টাকা না পৌঁছনোয় জঙ্গলে কোনও কাজই প্রায় হয়নি। বন দফতরের রেঞ্জার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মানস আচার্য বলেন, “পরিস্থিতির কথা বনমন্ত্রী এবং বনসচিবকে জানানো হয়েছে।” |
কিন্তু এমন হল কেন? মূল কারণ রাজ্য সরকারের নয়া বিধির ফতোয়া সব দফতরেই আর্থিক লেনদেন হতে হবে ট্রেজারির মাধ্যমে। এত দিন আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বনাধিকারিকেরাই ছিলেন ‘ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সমেন্ট অফিসার’। তাঁদের অনুমতিক্রমে পরিকল্পনা বহির্ভুত খাতের টাকায় বন দফতরের অধিকাংশ কাজ হত। কিন্তু এখন চারা রোপন থেকে দেখভাল বা জঙ্গল সাফাই, সব কাজের টাকাই মেটানো হচ্ছে ট্রেজারি মারফত। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এতটাই সময়সাপেক্ষ যে, সময়ে টাকা না পাওয়ায় চারা পোঁতা যায়নি। দীর্ঘসূত্রিতার ফলে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ী বনকর্মীদের বেতনও আটকে গিয়েছে।
ট্রেজারি আইনের ‘ফাঁদে’ টাকা আটকে গিয়েছে বলে মানছেন বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনও। এ ব্যাপারে অচিরেই অর্থ দফতরের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে আশ্বাস তাঁর। বনমন্ত্রীর আক্ষেপ, “কাগজে-কলমে টাকা আছে। কিন্তু বনাধিকারিকদের হাতে নেই। ফলে পশুখাদ্য রোপন কিংবা জঙ্গল সাফাইয়ের কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। আগামী মরসুমে যাতে তা না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
কিন্তু আগামী মরসুম তো পরের কথা! এ বছরে যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেক বনাধিকারিক। বন রক্ষণাবেক্ষণ থেকে সবুজায়ন, এমনকী তৃণভোজীদের জন্য জরুরি ঘাস লাগানো (ফডার প্ল্যান্টেশন) কোনও কাজই হয়নি। হয়নি আগের বছরগুলিতে লাগানো কয়েক লক্ষ চারার রক্ষণাবেক্ষণও। এমনকী আগাছা সাফাই বা ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছ তুলে আনার (জঙ্গলের পরিভাষায় ক্লিনিং) কাজও ঠিক মতো হয়নি। বনাধিকারিকদের বক্তব্য, এ বছর ক্লিনিং-এর কাজ ঠিক মতো করতে করতে না পারায় সরকারের একশো কোটিরও বেশি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এই বিষয়টি বনমন্ত্রী ও বনসচিবকে এক স্মারকলিপিতে জানানোও হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত গাফিলতির চেহারা। যার খেসারত আগামী বসন্তে দিতে হবে আদিগন্ত বনাঞ্চল এবং লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দাদের। উত্তর কিংবা দক্ষিণবঙ্গের গাঁ-গঞ্জে বন ছেড়ে জনবসতে হাতির নিরন্তর আনাগোনা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এ বার ‘বন-বিবাগী’দের সেই তালিকায় ঠাঁই হতে চলেছে গন্ডার, বাইসন-সহ তামাম তৃণভোজী-কুলেরও।
খবর কানে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ‘প্রজেক্ট এলিফ্যান্ট’-এর ডিরেক্টর এএন প্রসাদেরও। তাঁর বক্তব্য, বর্ষায় ‘ফডার’ লাগালে মাসকয়েকের মধ্যেই তা বেড়ে শীতে হাতির খাবার যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু জঙ্গলে তার হদিস না পেলে খাবারের খোঁজে গ্রামাঞ্চলে হাতির হানা বাড়তে বাধ্য। গন্ডার নিয়ে কাজিরাঙ্গার জঙ্গলে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন গৌতম শইকিয়া। তাঁর অভিজ্ঞতা, “ঘাস খাওয়ার সময়ে তার শেকড় সমেত উপড়ে ফেলে গন্ডার। ফলে চেপ্টি, মালসার মতো ঘাস-বিচালি প্রতি বছরই বন দফতরকে নতুন করে রোপন করতে হয়। না হলে খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবেই।”
বর্ষার মাঝামাঝি, তিন মাসের জন্য (১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) বন্ধ হয়ে যায় রাজ্যের সমস্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জঙ্গলে নতুন চারা লাগানো (প্ল্যান্টেশন), পশু-পাখিদের খাদ্য তালিকার ঘাস লাগানো (ফডার প্ল্যান্টেশন), আগাছা সাফাই (ক্লিনিং), গত মরসুমে লাগানো চারার বাড়বৃদ্ধির দেখভাল এমনই অজস্র কাজ এ সময়েই করেন বনকর্মীরা।
এক বনকর্তার কথায়, “বর্ষার এই তিন মাস জঙ্গলকে সাজিয়ে তোলার সময়। গত বারের লাগানো চারাগুলি কতটা বড় হল, আগাছায় ঢেকে গেল কি না, চারায় সার দেওয়া বা হাতি, গন্ডার, বাইসন এমনকী বাঁদরের খাবারের জোগানে যাতে টান না পড়ে সে জন্য নতুন ‘ফডার’ লাগানো, কিছুই হয়নি এ বার।” চারা লাগানোর পরে পাঁচ বছর ধরে তার রক্ষণাবেক্ষণ (বন বিভাগের ভাষায় ‘মেনটেনেন্স’) করা হয়। আগাছায় ঢাকা পড়ে চারা যাতে অকালে নষ্ট না হয়, তিন মাস ধরে তাই আগাছা সাফাই চলে নিরন্তর।
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বর্ষায় রাজ্যের ৪৭১টি রেঞ্জের অধিকাংশে এই সব কাজের ছিটেফোঁটাও হয়নি। রাজ্যের মোট আয়তনের ১৩.৪ শতাংশ স্বীকৃত বনভূমি। ২০১০-১১ আর্থিক বছরে ১৪.০৩ হাজার হেক্টর জমিতে চারা রোপন করেছিল বন দফতর। কিন্তু ২০১১-১২ আর্থিক বছরে তা অর্ধেকেরও কম জমিতে নেমে আসে। বন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি আর্থিক বছরে সিকি ভাগ জমিতেও চারা রোপন করা যায়নি। এত দিন অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত ফরেস্ট প্রোটেকশন কমিটির (এফপিসি) সদস্যেরাই ওই কাজের সিংহভাগ করতেন। জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের ওই সব বাসিন্দাদের রুজিও থমকে গিয়েছে।
এক বনকর্তার প্রশ্ন, “পূর্ত আর বন দফতর তো এক নয় যে, রাস্তা তৈরির টাকা দশ মাস পরে পেলেও চলবে। বন দফতরের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে করতে হয়। যেমন, বর্ষা চারা লাগানোর সময়। বীজ সংগ্রহের সময় শীত। কিন্তু টাকা আসতে বসম্ত পেরিয়ে গেলে চলবে কী করে?”
কিন্তু, আপাতত উপায়?
বন দফতর এখন তারইউত্তর হাতড়াচ্ছে। |