প্রবন্ধ ২...
ক্ষমতার স্বাদই বন্দুকের উৎস
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সঙ্গে লোবা গ্রামের পরিস্থিতির অনেকখানি মিল। একটা বড় অমিল, তাঁদের চাষজমি দখল করে সেই মাটি থেকে কয়লা তোলা হবে, এই প্রস্তাবে লোবার মানুষরা ‘না’ বলেননি। তাঁরা জমি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তার জন্য ক্ষতিপূরণ কী হবে, পুনর্বাসনের কী ব্যবস্থা হবে এই বিষয়গুলি তাঁরা জমি দেওয়ার আগেই জানতে চান। শুধু চাষের জমি তো নয়, এগারোটা গ্রাম খনির গর্ভে চলে যাবে যে। তাই, প্রশ্নগুলো ওঠা আশ্চর্যের নয়।
লোবার মানুষ এখনও অন্ধকারে। এই খনির মূল বরাত পেয়েছে ডিভিসি। ‘এমটা’-কে সাব কনট্রাক্ট দিয়েছে তারা। গ্রামবাসীরা ‘তথ্য জানার অধিকার’ আইন প্রয়োগ করে ডিভিসি-র কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে কী চুক্তি হয়েছে ডি ভি সি এবং এমটা-র মধ্যে? উত্তর নেই। বরং ৪৭টা গাড়ি-বাইক চেপে পুলিশ এসেছে, ‘পে লোডার’ আটকে রাখা গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চলেছে।
পরিবর্তিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঘোষিত নীতি হল, জমি অধিগ্রহণে কোনও ভাবেই সরকার কোনও ভূমিকা নেবে না। ক্রেতা-বিক্রেতা নিজেরাই দরদাম ঠিক করে নেবে। এই নীতিকে মান্যতা দিতে গেলে কিন্তু তৃতীয় কোনও উপস্থিতির প্রশ্ন নেই। অথচ ২০১০ সালে ‘এমটা’ দুবরাজপুরে অফিস খোলার পর থেকেই জমির দালালের উৎপাতে লোবার মানুষ অতিষ্ঠ। এই দালালরা স্থানীয় স্তরে ক্ষমতাবান, ফলে তাদের অগ্রাহ্য করাও কঠিন।
প্রশাসন হাত ধুয়ে ফেলেছে। ‘এমটা’-র কোনও দায়বদ্ধতা এখনও প্রকাশ পায়নি। ডিভিসি নিরুত্তর। এই অবস্থার ঠিক কী ব্যাখ্যা দেওয়া যায়? গ্রামবাসীরা প্রশ্ন করেন, ‘এই অবস্থায় তাঁদের কর্তব্য কী?’
ঠিক কী রকম গণতন্ত্রে আমরা বাস করি? সেখানে সাংবিধানিক কোনও বাতাবরণ আছে কি? নাগরিক সমাজকে আইন এবং সংবিধানের রক্ষাকবচ দেওয়ার দায় এই গণতন্ত্র আদৌ মান্য করে কি?
যদি প্রথম থেকে ঘটনা পরম্পরায় চোখ রাখি, তা হলে দেখব, আইন মান্য করার সমস্ত দায় কেবল নাগরিকের। শাসকের দায় নেই। দায়িত্বও নেই। ২০০৬ সালে যখন প্রথম জমির নীচের কয়লার কথা শোনা গেল, তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নয় মিটিং হয়েছিল শাসক দলের কৃষকসভার পক্ষ থেকে। যদিও তখন সরকার নিজেই জমি অধিগ্রহণ করার নীতি নিয়েছিল।
তার পর পরিবর্তিত সরকার এল। যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণ হবে না, তাই আর কোনও দায়িত্ব নিল না। ক্ষমতাবান দালালরা অবশ্য কাজে নেমে পড়ল। প্রশাসন তাদের নিরস্ত করার দায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। দালালরা ইতিমধ্যে ‘এমটা’র হয়ে ৫০০ একর জমি, ছড়ানো-ছিটানো ভাবে, কিনে নিতে পেরেছে। জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে জনৈক নির্মল কুমার সরকারের নামে। এ ছাড়া ‘এমটা’র আর কারও নামও গ্রামবাসীদের জানা নেই। মাছ ধরার সুবিধা করতে জল ঘোলা করে রাখা, লোবা থেকে ঘুরে এসে সন্দেহ হয়।
খোলা-মুখ খনির ভয়াবহতা এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। যে তিন হাজার তিনশো তিপ্পান্ন একর জমিতে এই খনি হবে, শুধু সেখানেই নয়, তার পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকশো একর দূষণের কবলে পড়বে। গোটা অঞ্চলের আবাদ শুধু নয়, স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে মানুষের বসবাস আর আদৌ সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও আছে। এই দূষণ এবং দূষণ-পরবর্তী অঞ্চলের দায়িত্ব কার? যদি সরকার সে দায়িত্ব না নেয়, তাহলে খনি খনন করার অধিকার কি তার থাকে?
প্রশ্ন থাকে আরও। ‘এমটা’র যদি নিরাপত্তা দরকার হয়, তা হলে যেমন প্রশাসনকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে, তেমনি নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রশাসনেরই দায়িত্ব।
আপাতভাবে মনে হয়, এ সবই বুঝি প্রশাসনিক অপদাথর্তা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এর মূল কারণ আরও গভীরে। টেবিলের ও ধারে শাসন করার জন্য যাঁরা বসে আছেন, আইন বা সংবিধান কিছুই তাঁদের জন্য নয়। তাঁরা মনেই করেন না যে যে আইনে নাগরিক বাঁধা, সেই আইনে তাঁরাও বাঁধা। আরও একটু সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, বলতে হয়, সাংবিধানিক যে বাতাবরণের ভেতর গণতন্ত্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, সেই বাতাবরণ এখনও পর্যন্ত তৈরিই হয়নি আমাদের দেশে। আর তাই এই ঔদ্ধত্য।
এই ঔদ্ধত্য আসে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার সুবাদে। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে যখন কোনও সরকার তৈরি হয়, তখন সেই সমর্থনের ভারই পার্টি এবং প্রশাসনকে সংবিধান লঙ্ঘন করার, আইন অগ্রাহ্য করার মনোবল জোগায়। পশ্চিমবঙ্গে এই অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু পরিবর্তনের পরও যে নতুন অভিজ্ঞতা হল না চিন্তার বিষয় সেটাই। এই জনসমর্থন ভুলিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে ক্ষমতার ব্যবহার আর বিরোধী দলের যথার্থ স্বীকৃতির মধ্যে। সমর্থন আছে বলেই যে যথাচ্ছাচার চলে না, নাগরিক সমাজকে তার প্রাপ্য পরিসরটুকু না দিলে, কেবল সংখ্যা কোনও গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।
লোবার ঘটনা প্রমাণ করে যে, শাসককেও গণতন্ত্রের যোগ্য হয়ে উঠতে হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.