হলিউেডর ক্যামেরা রানাঘাটের মেয়ে
প্রথম তাঁর কথা শুনেছিলাম দু’বছর আগে। হলিউডের দুষ্টু মেয়ে লিন্ডসে লোহানের সঙ্গে একটি বাঙালি মেয়ের সমকামী সম্পর্ক নিয়ে জোর গুজব তখন। খোঁজ করে জানলাম মেয়েটির জন্ম কলকাতায়। ছেলেবেলা কেটেছে রানাঘাট আর কলকাতায়। তবে ছ’বছর বয়সে দেশ ছেড়ে বাবা-মা’র সঙ্গে পাড়ি দেন লন্ডনে। কারণ, একদিন কলকাতায় বাড়ির সামনে একটি রাজনৈতিক গোলমালের ফলে ছোট্ট মেয়েটি কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে দিশাহারা হয়ে পড়ে। লন্ডন থেকে টরন্টো হয়ে একেবারে বেভারলি হিলস। এরই মধ্যে স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের কাছে মন্ত্র নেওয়া। রানাঘাটে স্কুল স্থাপন। আজ হলিউডের অন্যতম ব্যস্ত ফোটোগ্রাফার ইন্দ্রাণী পাল চৌধুরি। উইল স্মিথ, কেটি হোমস, কেট বেকিনসেল, ইভা মেন্ডেস, অ্যান হ্যাথাওয়ে, ব্রিটনি স্পিয়ার্স, ক্রিস্টিনা অগিলেরা, কানিয়া ওয়েস্ট, ভ্যাল কিলমার কে নেই তাঁর মডেলের তালিকায়? বই লিখে ফেলেছেন। ছবিও পরিচালনা করেছেন। ডিসেম্বরে লিঙ্কন সেন্টারে তাঁর ছবির বিশাল প্রদর্শনী। ইচ্ছে আছে সেই প্রদর্শনীকে কলকাতায় নিয়ে আসারও।
রানাঘাটের কথা জিজ্ঞেস করতেই ইন্দ্রাণীর প্রথমে মনে পড়ে তার তিনশ’ বছরের পুরনো বসতবাড়ির কথা। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। “ছোটবেলায় বাড়িতে অনেক গল্প শুনেছি ভারতের ঐতিহ্য আর ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে। বাবা বলতেন, কী ভাবে আমার ঠাকুরদা, কৃষ্ণ পন্তী, হতদরিদ্র অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন,” ইন্দ্রাণী বলেন। ঠাকুরদা স্কুল স্থাপন করেছিলেন। হাসপাতালও।
ফোটোগ্রাফি প্রথম প্রেম হলেও ইন্দ্রাণীকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় তাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগে। টরন্টোর একটা স্টুডিওতে ফোটোগ্রাফি করতে চাইলেও তাঁর অনুরোধ নাকচ হয়ে যায়। কেউ বলে এত অল্প বয়েসে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে শু্যট করা সম্ভব নয়। অন্যদের বক্তব্য যে ইন্দ্রাণীর জন্ম হয়েছিল ক্যামেরার সামনে থাকার জন্যই। যদিও উনি একজন সাধারণ মডেলের থেকে উচ্চতায় পাক্কা চার ইঞ্চি ছোট। মডেলিং শুরু করেন চোদ্দো বছর বয়সে। একদিকে মডেলিং, অন্যদিকে ল্যাটিন চর্চা। ‘গ্ল্যামার’ আর ‘এল’ পত্রিকার জন্য শুরু হয়ে যায় কাজ। লাগাতার শু্যট। তার সঙ্গেই প্রিন্সটনে পড়াশোনা। সংস্কৃত আর বেদান্ত নিয়ে। একটা প্রোগ্রামও তৈরি করেন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ওপর। গ্র্যাজুয়েশন করেন কালচারাল অ্যান্থ্রোপলজি নিয়ে। থিসিস লেখেন ‘ইন পারসিউট অব হ্যাপিনেস: ডিজায়ারস ইন হিন্দুইজমস বেদান্ত ফিলোসফি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’।
তবে ফোটোগ্রাফির প্রেম কখনই তাঁকে ছাড়েনি।
জীবন বদলে যায়, যখন উনিশ বছর বয়সে হঠাৎ পরিচয় হয় ফোটোগ্রাফার মার্কাস ক্লিঙ্কোর সঙ্গে। জিজ্ঞেস করি, কী ভাবে শুরু হয় একসঙ্গে কাজ করা। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ইন্দ্রাণী বলেন, “বিখ্যাত ফ্যাশন আইকন ইসাবেলা ব্লো আমাদের ‘সানডে টাইমস’-এর কভার শু্যট করতে বলেন। ব্রিটিশ শিল্পী ডেভিড বাওউই বলেন, তাঁর ‘হিদেন’ অ্যালবামের জন্য ছবি তুলতে।”
কখনও বিয়ন্সেকে হিরে দিয়ে সাজিয়ে, কখনও লেডি গাগাকে হ্যালো কিটি পুতুলের জামা পরিয়ে আমরা ছবি তুলি। আবার কিম কার্দেশিয়ানের সঙ্গে নো মেকআপ শু্যটিংও করেছি।”

বিয়ন্সে

কিম কার্দেশিয়ান
ফোটোগ্রাফি পেশা ও নেশা হলেও ইন্দ্রাণী সব সময় চেয়েছেন কাজের বাইরে একটা অন্য জীবনকে আপন করে নিতে। “আমার বাবা (অজয় পাল চৌধুরি) আর মা (গ্রেটা) জীবনের অনেকটা সময়ই চ্যারিটির কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। কখনও মাদার টেরেসার কাজে। কখনও বা রামকৃষ্ণ মিশন গোলপার্কে। ভারতে এসে একটা ফাউন্ডেশন বানাই। নাম শক্তি এম্পাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশন। তবে এত কিছুর পরেও রানাঘাটের স্কুলের বাচ্চাদের কাছে আমি কিন্তু শুধুই ওদের জুলিদি,” জানালেন ইন্দ্রাণী।
আজকাল পরিচালনা করছেন বিজ্ঞাপন আর মিউজিক ভিডিও। প্রথম ডকুমেন্টারি পরিচালনা করেছেন কঙ্গোর জঙ্গলে গিয়ে। ওটা ছিল ইউনাইটেড নেশনসের ‘নাথিং বাট নেটস’-এর জন্য। অভিনেত্রী ম্যান্ডি মোরের সঙ্গে। এর পর ভারত আর আফ্রিকাতে এডসের প্রকোপ নিয়ে আবার ডকুমেন্টারি। “এর জন্য মার্কাস আর আমি কুড়ি জন সেলিব্রিটিকে নিয়ে কফিনের মধ্যে শু্যট করি। এর জন্য দুটো গোল্ডেন লায়নও পাই,” ইন্দ্রাণী জানান। ডকুমেন্টারি থেকে তার পর চলে যান শর্টফিল্ম বানাতে। নাম ‘দ্য লেজেন্ড অব লেডি হোয়াইট স্নেক’। ফ্যাশন আইকন ড্যাফনে গিনেস অভিনয় করেন তাতে। “এই ছবিটি বানিয়ে প্রচুর প্রশংসা পাই। বেস্ট ফিল্ম, বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট ভিশু্যয়াল এফেক্টস, বেস্ট ফ্যাশন আর দ্য রেড ক্যামেরা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি দুনিয়ার অন্যতম সেরা ফ্যাশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সম্প্রতি ‘আইকনস’ বলে আমার ফোটোগ্রাফির বই প্রকাশিত হয়েছে। অস্কারজয়ী ‘ব্ল্যাক সোয়ান’-এর প্রযোজকের জন্য একটা ফিচার ছবি পরিচালনা করতে চলেছি,” বলেন তিনি।
তবু জানতে ইচ্ছে হয় এত সবের মধ্যে নিজেকে কতটা বাঙালি রাখতে পেরেছেন? “দুভার্গ্যবশত বাংলাটা আমি আর গড়গড়িয়ে বলতে পারি না। যদিও সংস্কৃত চর্চা করেছি চার বছর ধরে। হলিউডে বসে আজও বাংলার শিল্প আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়,” ইন্দ্রাণী বলেন। ছোটবেলা থেকে ফোটোগ্রাফি আর সিনেমার ঝোঁক। কিন্তু বাড়িতে ছবি দেখা মানা ছিল। তবে রেওয়াজ ছিল ফোটোগ্রাফি আর গল্পদাদুর আসরের। “ছবি তোলার হাতেখড়ি একটা পোলারয়েড ক্যামেরাতে। বাড়ির সকলের জন্য এই ক্যামেরাটা বরাদ্দ ছিল। পাঁচ বছর বয়সে বেড়াতে গিয়ে আমি বাড়ির সবার ছবি তুলি ওটা দিয়ে। তার পর মডেলিংয়ের পয়সা দিয়ে একটা নিকন ক্যামেরা কিনে ফেলি। ওই ক্যামেরাটা দিয়েই সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে ছবি তুলি,” উনি বলেন।
তবে মার্কাসের সঙ্গে প্রথম বড় শু্যট করতে গিয়েই ওই ক্যামেরাটা খারাপ হয়ে যায়। “আমি একটা বড় শু্যটের পরিকল্পনা করতে গিয়ে আনমনা হয়ে যাই। বুঝতেই পারিনি, কখন ক্যামেরা হাতে আমি একটা পুলে পা-পিছলে পড়ে গিয়েছি,” হাসতে হাসতে বলেন।
আজকাল ইন্দ্রাণী ‘রেড এপিক’ ক্যামেরা ব্যবহার করেন। প্রাইজে পাওয়া। ফোটোগ্রাফি করতে গিয়ে অনেক নিয়ম ভেঙেছেন। অনেকে বলেন সূর্যের দিকে তাক করে ছবি তোলা উচিত নয়। কিন্তু ইন্দ্রাণী তা প্রায়ই করে থাকেন। পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজও অন্যের হাতে ছাড়েন না। “ভারতীয় ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে প্রবুদ্ধ দাশগুপ্তর কাজ ভাল লাগে। ছবি বলতে বুঝি সত্যজিৎ রায়, অপর্ণা সেন। ইচ্ছে আছে ফ্রিডা পিন্টো এবং ঐশ্বর্যা রাই বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার। ভারতীয় মাইথোলজি নিয়েও ছবি পরিচালনা করতে চাই আমি,” ইন্দ্রাণী তাঁর স্বপ্নের কথা জানান।
এত কাজের মধ্যেও প্রেম এসেছে জীবনে। মার্কাসের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই প্রেম। তবে আজ ওঁরা শুধুমাত্র ভাল বন্ধু। আর লিন্ডসে? “যখন মিডিয়া পাগলের মতো আমার আর লিন্ডসের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছে, তখন আমার নাম গুগলে সবথেকে বেশি সার্চ করা মানুষদের লিস্টে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। আমি লিন্ডসের সঙ্গে অনেক শু্যট করেছি।
ও কতটা কী করতে পারে, আমি জানি। সেই নিয়ে কথা বলতে গিয়েই যত জটিলতা শুরু। তবে আমি সব ধরনের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনকে সমর্থন করি। তাই এই সব গুজবে কান দিইনি।”
আপাতত ইন্দ্রাণী অপেক্ষা করছেন ভারতে ফেরার। শেষবার ভারতে এসেছিলেন মুম্বইয়ের বস্তিতে একটা শর্ট ফিল্ম ‘দ্য গার্ল এপিডেমিক’ শু্যট করতে। কলকাতাকে দেখাতে চান তাঁর ‘আইকনস্’। আর তার মধ্যে রানাঘাটেও ফেরার জন্য মনটা আকুল। বাঙালি রান্না অনেক দিন খাওয়া হয়নি। হলিউডের ব্যস্ত জীবনের মধ্যে আজও ফুলকো লুচি, মাছের কালিয়া আর জিলিপির স্বাদ মুখে লেগে আছে।

আমি

ইন্দ্রাণী পাল চৌধুরি
বেভারলি হিলসে থাকি।
আমি কিন্তু রানাঘাটের মেয়ে।
চোদ্দো বছর বয়েসে মডেলিং আরম্ভ করি কানাডায়। পড়াশুনা প্রিন্সটনে। সংস্কৃত পড়ি। আর বেদান্ত। মন্ত্র নিয়েছি স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের কাছে। তবে প্রথম প্রেম স্তোত্র নয়, ক্যামেরা। প্রথম ক্যামেরা নিকন। মডেলিংয়ের রোজগার দিয়ে কেনা। দ্বিতীয় প্রেম জিলিপি, যা একমাত্র রানাঘাটেই পাওয়া যায়।

আমার মডেল
অনেক সেলিব্রিটির সঙ্গে আমি কাজ করেছি। প্রথম যখন জেনিফার লোপেজের সঙ্গে দেখা করি, তখন উনি সম্পূর্ণভাবে মেকআপহীন। ওঁর বুদ্ধিমত্তা আর স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। উনি চেয়েছিলেন কালো ঠোঁট আর গোলাপের কাঁটা দেওয়া একটু ডার্ক শট। ওঁর শরীরে ছায়া ফেলে সেটাই করলাম আমরা। যখন একটা পত্রিকার জন্য কেট উইন্সলেটকে শু্যট করিয়েছিলাম, উনি তখন ফ্লুতে আক্রান্ত। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই খুব তাড়ায় ছিলেন। সেই জন্য একজন স্ট্যান্ড-ইন মডেল নিয়ে সাধারণ একটা সেট-আপ তৈরি করে আমরা কেটকে বললাম, শুধু পনেরো মিনিট তাঁর পুরো অ্যাটেনশনটা দিতে। ওই সময়টুকুর মধ্যেই উনি আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি ‘কানেক্ট’ করে ফেললেন। বিয়ন্সের ক্ষেত্রে শু্যটিং করার অভিজ্ঞতাটা ছিল পুরোপুরি আলাদা। হঠাৎ আমি দেখতে পাই একটা ক্রিস্টাল টপ ওঁর রিজেক্টেড স্টাইলিংয়ের জিনিসের মধ্যে। ওঁকে বোঝালাম, আমি ওঁর স্ট্রাকচারাল গ্যাপগুলো পোস্ট-প্রোডাকশনে ঢেকে দিতে পারব। সিল্ক স্কার্ট না পরে ওই টপটার সঙ্গে ক্যাজুয়াল কিছু পরতে বললাম। আমার সহকর্মী মার্কাস ক্লিঙ্কো বললেন, জিন্সই ভাল। বিয়ন্সে সেদিন জিন্স আনেননি। মার্কাস ওঁর জিন্সটা ধার দেয়। দু’জনেরই সাইজ এক। বিয়ন্সেও রাজি!

কেট উইন্সলেট

জেনিফার লোপেজ

প্যারিস হিলটন

ডায়েন ক্রুগার



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.