ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের অনাস্থা প্রস্তাব আনার বহু-বিজ্ঞাপিত প্রয়াস যে মুখ থুবড়াইয়া পড়িবে, তাহা জানাই ছিল। মাত্র ১৮ জন সাংসদ লইয়া পাঁচশতাধিক সদস্যের সভায় নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা-প্রস্তাব আনিবার যৌক্তিকতা কী, তাহা দলীয় সাংসদদের কাছেও সম্ভবত স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু দলনেত্রীর অভিপ্রায় লইয়া সংশয় প্রকাশের অভ্যাস তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদের নাই। বস্তুত, কংগ্রেসকে খানিক নাকাল করা ভিন্ন আর কোনও উদ্দেশ্য তৃণমূলনেত্রীর ছিল, এমন সন্দেহ করিবার কোনও কারণও নাই। কিন্তু তাঁহার দলে কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। অতএব খুচরা বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগ লইয়া বিরোধী ও সমর্থক সব দলই যখন সংসদে তুমুল বাগ্বিতণ্ডার জন্য প্রস্তুত হইতেছে, মাসখানেক আগে অবধি ইউপিএ-র শরিক থাকা তৃণমূল নেতৃত্ব তখন এই প্রশ্নে নিজেদের সম্পূর্ণ একঘরে ও হাস্যাস্পদ করিয়া ফেলিল। হাসির খোরাক বাড়াইয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ‘ফেসবুক’-এ লিখিলেন যাহারা তাঁহার অনাস্থা-প্রস্তাব সমর্থন করিল না, জনগণ তাঁহাদের স্বরূপ চিনিয়া রাখিলেন, ইত্যাদি।
অনাস্থা প্রস্তাব সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের পতন ঘটাইবার একটি মোক্ষম হাতিয়ার। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সর্বপ্রথম এই প্রস্তাব আনে ১৭৮২ সনে প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থের বিরুদ্ধে, যখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধে ইয়র্কটাউনে পরাস্ত হয়। তদবধি ব্রিটেনে মোট ১১ বার অনাস্থা-প্রস্তাবে সরকারের পতন হইয়াছে। কিন্তু ১৯২৫ সাল হইতেই এ ভাবে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনের সংসদীয় ঐতিহ্যটি হ্রাস পাইতে থাকে। বস্তুত সেই হইতে মাত্র এক বারই অনাস্থার মুখে পড়িয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় লইতে হয়, যখন জেমস কালাহান ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের আগমনী প্রশস্ত করেন। ব্রিটেনে দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত ক্রমশ সংসদীয় রাজনীতির দখল লওয়াতেই অনাস্থা-প্রস্তাব আনার প্রবণতা কার্যত বিরল হইয়া যায়। ইউরোপের যে সব দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা, ত্রিশঙ্কু পার্লামেন্ট এবং জোট সরকার কায়েম হয়, সেখানে অবশ্য অনাস্থা-প্রস্তাবের ছড়াছড়ি। যেমন ইতালিতে, বিশেষত ৫০ হইতে ৯০-এর দশক পর্যন্ত। এবং অধুনা জাপানেও। তবে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও ইজরায়েলেও স্পষ্ট সংসদীয় গরিষ্ঠতার অভাব সরকার গঠন ও সঞ্চালনে ঘোর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা ঘনাইয়া তুলিয়াছিল। জার্মানির ‘ওয়াইমার রিপাবলিক’ কিংবা ফরাসি ‘ফোর্থ রিপাবলিক’-এর সময় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ঘন-ঘন অনাস্থায় শাসন পরিচালনাই দুঃসাধ্য হইয়া ওঠে। ফ্রান্স সমস্যাটির মীমাংসা করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়াইয়া দিয়া। আর জার্মানি তাহার চ্যান্সেলরের ক্ষমতা বাড়াইবার পাশাপাশি নিয়ম করিয়া ফেলে, অনাস্থা আনয়নকারী দলকে নির্বাচিত পার্লামেন্টের অবশিষ্ট মেয়াদ সরকার চালাইবার উপযুক্ত বিকল্প প্রণয়ন করিতে হইবে। স্পেন ও ইজরায়েলও পরে জার্মানির পদাঙ্কই অনুসরণ করে।
অর্থাৎ অনাস্থা-প্রস্তাব যদি থাকেও, তাহা কেবল অপছন্দের সরকারের পতন ঘটাইবার নেতিবাচক হাতিয়ার রূপে প্রয়োগ করিলে চলিবে না, সেই সঙ্গে দেশে সরকার চালু রাখিবার গঠনমূলক বিকল্পও প্রস্তাবকারীকে দিতে হইবে। অনাস্থা-প্রস্তাব তাই এ ক্ষেত্রে একই সঙ্গে আস্থা-প্রস্তাবও বটে। মোট কথা, কোনও ক্রমেই নির্দিষ্ট কালপর্বের ব্যবধানে ছাড়া জনসাধারণের উপর নির্বাচনের বোঝা চাপাইয়া দেওয়া চলিবে না। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই ইউরোপীয় গণতন্ত্রের এই দায়িত্ববোধ শিখিতে প্রস্তুত নয়। বহুদলীয় ব্যবস্থাকে এখানে কেবল বৃহৎ জাতীয় দলের সহিত আঞ্চলিক ক্ষুদ্র দলগুলির দরকষাকষির সুযোগ হিসাবে দেখা হয়। সেই দরকষাকষি জনকল্যাণ লইয়া তত নয়, যতটা জোট-মন্ত্রিসভায় দলের কোটাবৃদ্ধির মতো সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা প্রাণিত। তাই অনাস্থা-প্রস্তাব এখানে প্রায়শ হিসাব চুকাইবার, প্রতিশোধ লইবার, ডামাডোল সৃষ্টি করিয়া ভোটের বাক্স ভরিয়া লইবার কিংবা রাজনৈতিক নেতার অহমিকা চরিতার্থ করার অস্ত্র। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী সেই অস্ত্রটির অপব্যবহারকে এক নূতন মাত্রা দিয়াছেন। |