শহরের বাইরে সংলগ্ন জেলায় আর নয়, ত্রাস সৃষ্টি করা বন্দুকধারী ছিনতাইবাজদের ব্যাপারে এখনও অন্ধকারে থাকা গোয়েন্দারা তদন্তে দিশা পেতে এ বার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন খাস কলকাতার মধ্যেই।
কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীরা প্রথমে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও দুষ্কৃতী-দলকে সন্দেহ করেছিলেন। ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, মথুরাপুরে গ্রেফতার হওয়া দুষ্কৃতী সইফুদ্দিন লস্কর কলকাতায় পরপর ছিনতাইয়ে জড়িত। কিন্তু কোনও সন্দেহই মেলেনি। উল্টে দুষ্কৃতীরা এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বাধা পেলে গুলি চালাচ্ছে বা মারধর করছে। লালবাজারের গোয়েন্দাদের সন্দেহ, অন্তত দু’টি আলাদা দল লাগাতার ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলিতে জড়িত। একটি দল দক্ষিণ কলকাতা ও দক্ষিণ শহরতলিতে কাজ করছে। অন্য দলটির কাজের জায়গা উত্তর কলকাতা ও সল্টলেক। দু’টি দলের অধিকাংশ দুষ্কৃতীই কলকাতার বাসিন্দা বলে তদন্তকাকারীদের অনুমান।
যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “বন্দুকবাজ ছিনতাইকারীদের একাধিক দল রয়েছে। তাদের খোঁজ চলছে।” মূলত পার্ক স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, চেতলা, তারাতলা, একবালপুর, মোমিনপুর, খিদিরপুর, তিলজলা, তপসিয়া, চিৎপুর ও টালার কিছু অল্পবয়সী দুষ্কৃতীর খোঁজে উঠেপড়ে লেগেছেন গোয়েন্দারা। ছিনতাইকারী হিসেবে ওই যুবকদের নাম পুলিশের খাতাতেও আছে। কয়েক জন এখন বেপাত্তা বলে সন্দেহ আরও বেড়েছে গোয়েন্দাদের।
এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর বা পাথরপ্রতিমা থেকে মোটরবাইকে কলকাতায় এসে দুষ্কৃতীরা একটা সোনার হার আর কানের দুল ছিনতাই করার ঝুঁকি নেবে কেন? খরচেও পোষাবে না। তারা মুঙ্গেরে তৈরি নাইন এমএম পিস্তল জোগাড় করেছে, গুলি খরচেও তাদের কার্পণ্য নেই। বাইরে থেকে আসা দুষ্কৃতী-দল হলে বড় কাজ করত। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসে গুলি চালিয়ে এমন ছোটখাটো কাজ নয়।”
বস্তুত, ছিনতাই করতে এসে বাধা পেলে গুলি চালানোর বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, “আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছিনতাই করার এই প্রবণতা এখানকার অপরাধ জগতে নতুন। আগেও আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে লুঠপাট করেছে দুষ্কৃতীরা, যাতে কখনও ডাকাতি বা কখনও রাহাজানির মামলা রুজু হয়েছে। এখন ছিনতাইয়ের সময়ে বা পালানোর পথে বাধা পেলেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে তারা। আমাদের রেকর্ডের সঙ্গে সাম্প্রতিক এই অপরাধ মিলছে না।”
পুলিশের বক্তব্য, ওই ছিনতাইকারীরা মুঙ্গেরে তৈরি নাইন এমএম পিস্তল ব্যবহার করছে। বাখরাহাট, গোলাবাড়ির মতো এলাকায় হাজার দশেক টাকায় ওই অস্ত্র মেলে বলে দাবি পুলিশের। এক বারে অন্তত দশটি গুলি ‘লোড’ করে ছোড়া যায় ওই বন্দুক থেকে। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “পিছনে কোনও পুরনো মাথা থাকলেও মাঠে নেমে যারা কাজ করছে, তারা আগে ধরা পড়েনি। এদের বয়স ১৮-২৫ বছরের মধ্যে। দাগি হলে তারা জানত, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে, বিশেষ করে গুলি চললে, অস্ত্র আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সে ক্ষেত্রে শাস্তি আরও কঠোর, মামলা চলাকালীন জামিনে ছাড়া পাওয়াও কঠিন। ছিনতাইয়ের জন্য এতটা ঝক্কি দাগিরা কখনও নেবে না। এই দলটি ধরা না পড়তে বদ্ধপরিকর বলেই আগ্নেয়াস্ত্র রাখছে ও ব্যবহার করছে। কিন্তু এর পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।”
এত কিছু জেনেও দুষ্কৃতীদের এক জনকেও ধরা গেল না কেন? এক পুলিশকর্তার কথায়, “সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। সোর্স নেটওয়ার্ক কমে যাওয়ার সমস্যা তো আছেই। অতীতে ছিনতাইয়ের তদন্তে অনেক সময়েই প্রকৃত অপরাধীদের না ধরে অন্যদের ধরা হয়েছে। ছিনতাই হওয়া গয়নার পরিবর্তে অন্য গয়না জোগাড় করে উদ্ধার হওয়া জিনিস বলে দেখানো হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীরা এর ফলে শুধু আড়ালেই থেকে যায়নি, তাদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। সম্প্রতি সোনারপুরে দু’জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতারের পরে জানানো হয়, তারা একটি ছিনতাইয়ে জড়িত। কিন্তু পরে জানা গিয়েছে, ধৃত দু’জন ছিনতাইবাজ ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট ওই অপরাধ আদৌ তাদের কাজ নয়। এ সবেরই খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।” |