নিরীহ মালপত্রের ছদ্মবেশে বিমানে যে বোমা উঠছে, তা ধরতেই পারেনি এক্স-রে স্ক্যানার। তা সত্ত্বেও বিমানটি সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল স্রেফ গোয়েন্দাদের দেওয়া নিখুঁত তথ্যের দৌলতে।
সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে শিকাগো যাওয়ার পথে ওই পণ্যবাহী বিমানটিকে নামিয়ে আনা হয়েছিল লন্ডনে। ইয়েমেনের গোয়েন্দারা নিশ্চিত ছিলেন, বিমানে বোমা আছে। সে দেশ থেকে ওড়ার আগে বিমানের সমস্ত মালপত্র এক্স-রে করা হয়েছিল। কিছু পাওয়া যায়নি। লন্ডনে ফের এক দফা তল্লাশিতেও সেই একই ফল। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তারক্ষী ও বিশেষজ্ঞদের নজর পড়ে বিমানের মালপত্রের মধ্যে থাকা দু’টি লেজার প্রিন্টারের দিকে। তাঁদের সন্দেহ হয়, গোলমেলে কিছু রয়েছে হয়তো ওই প্রিন্টার দু’টিতেই। সেগুলিকে নামিয়ে এনে তোলা হয় এক্স-রে মেশিনে। আশ্চর্য! সন্দেহজনক কোনও ছবিই নেই। হাল না ছেড়ে বারবার প্রিন্টার দু’টিকে পরীক্ষা করা হয়। এবং এক সময়ে সত্যিটা বেরিয়েই আসে। দেখা যায়, ওই দু’টি প্রিন্টার আসলে ছদ্মবেশী আধুনিক বোমা যাকে বলে ‘ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি)।
ঘটনাটা ২০১০-এর অক্টোবরের। সম্প্রতি বিস্তারিত ভাবে এই ঘটনার কথা মনে করিয়ে প্রতিটি রাজ্য পুলিশের ডিজি, বড় শহরগুলির পুলিশ কমিশনার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে এক সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাতে বলা হয়েছে, বাক্স-প্যাঁটরার মধ্যে থাকা সন্দেহজনক বস্তু চিহ্নিত করতে এক্স-রে স্ক্যানার যথেষ্ট নয়। অনেক ক্ষেত্রে তা যে আইইডি শনাক্ত করতে ব্যর্থ, ইয়েমেনের ঘটনাই তার প্রমাণ। যদিও কলকাতা মেট্রো রেলের ২৩টি স্টেশনে এক্স-রে ব্যাগেজ স্ক্যানার বসানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর যশপাল সিংহের পাঠানো ওই সতর্কবার্তা রাজ্যের পুলিশকর্তাদের হাতে পৌঁছনোর আগেই।
আর কী বলা হয়েছে সতর্কবার্তায়? বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ছুরির মতো ধারালো অস্ত্র সহজেই শনাক্ত করতে পারে এক্স-রে স্ক্যানার। কিন্তু এখন নাশকতার জন্য জঙ্গিরা ব্যবহার করছে আইইডি। যার নির্দিষ্ট কোনও চেহারা, আকার ও গঠন নেই। এক্স-রে স্ক্যানারের পক্ষে সেগুলি শনাক্ত করা মুশকিল। দিল্লির উদ্বেগের বড় কারণ, জঙ্গিরা এখন ধাতব বস্তুহীন অথবা খুব সামান্য ধাতু ব্যবহার করে আইইডি তৈরির দিকে ঝুঁকছে। আইইডি-তে প্লাস্টিক বিস্ফোরক ব্যবহার করার প্রবণতা শুধু আল কায়দা নয়, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মধ্যেও বাড়ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য। সতর্কবার্তায় তারা এ-ও বলেছে, আইইডি-র বিস্ফোরণ ঘটাতে এমন রাসায়নিক ডিটোনেটর ব্যবহার করা হচ্ছে, যা এক্স-রে স্ক্যানারের পক্ষে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
তা হলে কি বিমানবন্দরের এক্স-রে মেশিনের ভিতর দিয়ে অনায়াসে আইইডি নিয়ে যে কেউ উঠে যেতে পারেন বিমানে?
ব্যুরো অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন সিকিওরিটি (বিসিএএস)-র এক কর্তার কথায়, “এক্স-রে মেশিনে ঢোকালে যাত্রীর ব্যাগের প্রতিটি জিনিসের ছবি ফুটে ওঠে কম্পিউটার মনিটরে। প্রতিটি জিনিসের ছবির ঘনত্ব আলাদা। ঘনত্বের সঙ্গে সঙ্গে আলাদা রংও ফুটে ওঠে পর্দায়। বিস্ফোরকের রং সাধারণত সবুজ ও কমলা হয়।” বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিআইএসএফ-এর এক কর্তা বলেন, “মেশিন নয়, যিনি মনিটরে নজর রাখছেন তাঁর উপরেই পুরোটা নির্ভর করে। কম ঘনত্বের সবুজ রঙের কোনও বস্তু দেখে তিনি খাবার ভেবে ছেড়ে দিতেই পারেন। কারণ, খাবারের ছবির রংও সবুজ হয়। এ রকম ভুলের ক্ষেত্রে কিন্তু মেশিনকে দোষ দেওয়া যাবে না।”
তবে ওই কর্তার দাবি, বিমানবন্দরের অফিসারদের এমন ভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে ব্যাগেজ স্ক্যানারে অতি ক্ষুদ্র জিনিসকেও তাঁরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেন। বস্তুত, ব্যাগেজ স্ক্যানার ব্যবহার নিয়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা অফিসারদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে সারা বছর ধরেই।
কিন্তু কেন্দ্র চায়, বিমানবন্দর ছাড়াও অন্য যে সমস্ত জায়গায় এক্স-রে স্ক্যানার রয়েছে (যেমন মেট্রো রেল), সেখানকার কর্মীদেরও একই ধরনের কম্পিউটার-ভিত্তিক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। এর ফলে পর্দায় ফুটে ওঠা বিভিন্ন জিনিসের আকার, চেহারা, রং ও ঘনত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে তাঁরা ক্রমশ এক্স-রে স্ক্যানার দিয়েই আইইডি শনাক্ত করতে পারবেন।
এ ছাড়াও রয়েছে পুলিশ-কুকুর। মন্ত্রকের পরামর্শ, বিস্ফোরক শনাক্ত করতে স্নিফার ডগের জুড়ি নেই। তাই তাদের বেশি করে ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে নিখুঁত গোয়েন্দা-তথ্য জোগাড়ের উপরেও জোর দিতে হবে। ঠিক যেমন তথ্য ইয়েমেনের গোয়েন্দাদের হাতে ছিল। রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র বলেন, “আইইডি শনাক্ত করতে এখানে পুলিশ কুকুর আছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিরাপত্তারক্ষীরা রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ মতোই কাজ হচ্ছে।” কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ইন্টেলিজেন্স) পার্থসারথি ঘোষের বক্তব্য, “এক্স-রে ব্যাগেজ স্ক্যানারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আমাদের জানা। সেটা জেনেই আমরা প্রস্তুতি নিই।”
|
অসহায় স্ক্যানার |
১৯৮৮ ডিসেম্বর |
• লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কের পথে স্কটল্যান্ডের লকারবির আকাশে প্যান অ্যামে বিস্ফোরণ, নিহত ২৭০। শক্তিশালী প্লাস্টিক বিস্ফোরক সেমটেক্স ছিল ক্যাসেট রেকর্ডারে। |
২০০১ ডিসেম্বর |
• প্যারিস থেকে মায়ামিগামী আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানে বিস্ফোরক নিয়ে ওঠে আল কায়দা জঙ্গি রিচার্ড রিড। স্পোর্টস শু-র সোলে ছিল বিস্ফোরক পিইটিএন ও টিএটিপি। যদিও ফাটেনি। |
২০০৯ ডিসেম্বর |
• আমস্টারডাম থেকে ডেট্রয়েটের পথে নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিমানে অন্তর্বাসে বিস্ফোরক নিয়ে ওঠে আল কায়দা জঙ্গি মুত্তালাব। শেষে ধরা পড়ে। |
২০১০ অক্টোবর |
• শিকাগোর বিমানে ইয়েমেনের সানা থেকে উঠল লেজার প্রিন্টারের আড়ালে থাকা পিইটিএন বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি আইইডি। লন্ডনে শনাক্ত মারণাস্ত্র। |
|