কলিকাতায় বণিকসভা ফিকি-র শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইল। সেখানে রাজ্য সরকার কোনও প্রতিনিধি পাঠায় নাই। রাজ্যের শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উজ্জীবনে ‘পরিবর্তনের সরকার’-এর দায়বদ্ধতা ও আগ্রহ কতখানি, এই অনুপস্থিতিতে তাহার সংকেত রহিয়াছে। দুর্ভাগ্যজনক সংকেত। উদ্বেগজনকও। ফিকি তথা শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের মনেও এই প্রশ্ন ওঠা নিতান্ত স্বাভাবিক। প্রায় একই সময়ে রাজ্যে অনুষ্ঠেয় চলচ্চিত্র উৎসব লইয়া মুখ্যমন্ত্রী-সহ সমগ্র রাজ্য প্রশাসনের তুমুল আগ্রহ এই সংশয়েরও জন্ম দিয়াছে যে, তথাকথিত মা-মাটি-মানুষের সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় চিৎপুরের যাত্রা-উৎসব কিংবা নন্দনের সিনেমা-সার্কাস অন্তর্ভুক্ত থাকিলেও রাজ্যের শিল্পায়ন তাহাতে অনুপস্থিত। তাহা যদি না হইবে, তবে শিল্পমন্ত্রী এই দিন ফিকির শীর্ষ বৈঠক এড়াইয়া সিউড়ির গণ-আন্দোলনের তত্ত্বতালাশ লইতে যাইবেন কেন? লক্ষণীয়, এক দিন পরেই আচমকা রাজ্যের শিল্প সংক্রান্ত ‘কোর কমিটি’র বৈঠক ডাকা হইয়াছে, যে বৈঠকের কোনও আলোচ্যসূচি পর্যন্ত স্থির হয় নাই। এক দিকে অনাগ্রহ, অন্য দিকে অস্থিরতা শিল্পের অনুকূল নয় নিশ্চয়ই।
অনুমান করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, লগ্নিকারীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের এই মানসিকতা ও মনোভঙ্গি লইয়াই মহা আতান্তরে পড়িয়া গিয়াছেন। মুখে বলা হইতেছে, রাজ্যে বিনিয়োগের পরিবেশ উত্তম, কর্মদিবস নষ্ট হওয়ার মাত্রা কমিয়াছে, বন্ধ-ধর্মঘট কার্যত নাই। কিন্তু এই ‘অনুকূল’ পরিবেশকে কাজে লাগাইতে সরকারের সদিচ্ছা বা তৎপরতা কোথায়? একে তো ছোট-বড় সব ধরনের জমি-অধিগ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নূতন শিল্পস্থাপনের জন্য জমি পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। উপরন্তু শিল্পপতি ও লগ্নিকারীদের সহিত উদ্ভট আচরণ, শিল্প মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী-আমলাদের তরফে শীতল আপ্যায়ন-অভ্যর্থনা, হঠাৎ-হঠাৎ বৈঠক ডাকিয়া বসা এবং সেই বৈঠকে অপালনীয় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি এ সবই শাসক দলের অভিপ্রায় ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে গভীর সংশয় সৃষ্টি করিতেছে। সরকার রাজ্যের শিল্পায়নে বাস্তবিকই আন্তরিক, নাকি কিছু লোকদেখানো ভঙ্গিসর্বস্বতার বাহিরে পা বাড়াইতে অনিচ্ছুক, সেই সংশয়। যাত্রা উৎসব কিংবা চলচ্চিত্র উৎসবের মতো অব্যাপারেষু ব্যাপারের খুঁটিনাটিতে (এমনকী মুম্বই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকাদের সাদরে বরণ করার মতো বিষয়েও) মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল ব্যক্তিগত উৎসাহ, নাক-গলানো এবং নিয়ন্ত্রণেচ্ছার পাশাপাশি লগ্নিকারীদের আকৃষ্ট করার ব্যাপারে তাঁহার দায়সারা মনোভাবও নজর এড়াইতেছে না।
ইহারই মধ্যে ‘লগ্নি টানিতে’ মুখ্যমন্ত্রীর বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন লইয়াও প্রশ্ন উঠিয়াছে। বিজয়া সম্মিলনী সামাজিক মিলন ও কুশল বিনিময়ের এক চমৎকার সুযোগ, সন্দেহ নাই। গত বছরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পপতিদের সহিত অনুরূপ সম্মিলনীর আয়োজন করিয়াছিলেন। তবে সেই সম্মিলনী হইতে কোনও শিল্পফল রাজ্যের জন্য প্রসবিত হইয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই, কেবল কুশলবিনিময়ই হইয়াছে। বিনিয়োগেচ্ছু শিল্পপতিরা সচরাচর এ ধরনের ‘সময়-নষ্টের’ আয়োজন হইতে দূরে থাকাই পছন্দ করেন। যাঁহারা ভদ্রতার খাতিরে বা সরকারের সহিত সুসম্পর্ক রাখিবার তাড়নায়, অর্থাৎ অগত্যা, উপস্থিত থাকিতে বাধ্য হন, সেই স্থানীয় শিল্পপতিরা মন্ত্রী ও আমলাদের সহিত শুষ্ক হাস্যবিনিময়ের অধিক কিছু করেন না। এ বারও করিবেন না। কারণ, বিনিয়োগের অনুকূল কোনও সুবিধা রাজ্যের সরকার তাঁহাদের সামনে হাজির করে নাই। শিল্প স্থাপনের জমি নাই, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হইতেছে, শাসক দলের গোষ্ঠীকোন্দল শ্রমিক-কর্মচারীদেরও প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করিয়া প্রকল্প-চত্বরে অরাজকতা সৃষ্টি করিতেছে, নির্বাচিত সাংসদরা জনাদেশে বলীয়ান হইয়া শিল্পসংস্থাকে হুমকি দিতেছেন, এক দিকে তালিকা ধরাইয়া কাজ দেওয়ার দাবি, অন্য দিকে যথেচ্ছ তোলাবাজি সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার প্রশাসনের তরফে এই সকল অনাচারের প্রতি ক্ষমাসুন্দর সহিষ্ণুতা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের যাবতীয় সম্ভাবনাকে নাকচ করিতেছে। চলচ্চিত্র উৎসবের আলোকসজ্জা এই অমানিশা দূর করিবে কী রূপে? |