অজয় নদের ধারে গ্রাম। মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে কাঁকর মাটির লাল রাস্তা। সেখানেই কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটা ‘তেপান্তর’ নামে চেনে সকলে। বর্ধমানের বনকাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন এই সাতকাহনিয়া গ্রামেই ১৩ বছর ধরে চলছে একটি আস্ত থিয়েটার ভিলেজ।
থিয়েটার ভিলেজ বা নাট্যগ্রাম। যে গ্রামের বাসিন্দারা সবাই নাট্যকর্মী। একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে নাটক করা, একসঙ্গে রোজগার করা।
কেউ কেউ কলেজে পা রেখেছিলেন। কারও কারও আবার ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি। অধিকাংশই কৃষক পরিবারের সন্তান। এখন নাটকই তাঁদের জীবন। নিজেরা জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ছোট ছোট মাটির ঘর তৈরি করে নিয়েছেন, লাগিয়েছেন গাছ। মাটি কেটে তৈরি হয়েছে পুকুর। কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকেও সম্প্রতি মাসে ৩৬ হাজার করে টাকা অনুদান আসে। তার সঙ্গে বাগানের ফলের গাছ, পুকুরে মাছচাষ আর পোলট্রি ফার্ম থেকে ভিলেজের খরচ জোগাড় করা হয়। বাকি সময়টা নাটকের অনুশীলন, প্রশিক্ষণ আর অভিনয়।
কখনও রতন থিয়াম, কখনও কানহাইয়া লাল। কখনও কলকাতার কোনও নাট্যগোষ্ঠী এখানে এসে প্রশিক্ষণ দিয়ে যান। হয় আন্তর্জাতিক নাট্য প্রশিক্ষণও। ২০০৫ সালে তেপান্তরে এসেছেন বার্লিন থেকে ফ্লাইং ফিশ থিয়েটার কোম্পানি, ২০০৮ সালে মস্কো থেকে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি ফর থিয়েটার আর্টস..। |
এই সব নিয়েই আছেন ওঁরা। প্রায় ৩০ জন সদস্য। এঁদের মধ্যে ১৫ জন সর্বক্ষণের জন্য থিয়েটার ভিলেজে থাকেন। ফার্মের কাজ, নাটকের কাজ দুইই করেন। বিয়ের পর এঁদের অনেকের স্ত্রী-ও যুক্ত হয়েছেন নাটকের সঙ্গে। বাদ বাকি ১৫ জন শুধু নাটকের কাজেই থাকেন। ছোট-বড় মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট ২৬টির মতো নাটক করেছেন ওঁরা। গত বছর দিল্লির এনএসডি-তে গিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে তাঁদের কাজ। প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নিজেরা একটি নাট্য-উৎসব করেন। সে সময় দিনে প্রায় ১২০০ দর্শক বাঁধা। বোলপুর, দুর্গাপুর, পানাগড়-সহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও দর্শক আসেন।
কেরলে ‘অভিনয় থিয়েটার’ বা ওড়িশার সুবোধ পট্টনায়কের তৈরি নাট্যগ্রামের খ্যাতি সুবিদিত। বর্ধমানের নাট্যগ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাসটা কী?
প্রথমে নিজের কিছু টাকা দিয়ে কেনা একটা জমি। তার পর ব্যাঙ্ক ঋণ। ‘তেপান্তর’-এর পিছনে প্রধান মস্তিষ্ক যিনি, তাঁর নাম কল্লোল ভট্টাচার্য। কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাটক দেখা এবং তাই নিয়ে পড়াশোনার শুরু। “কলকাতায় গিয়ে কোনও দলে যুক্ত হয়ে নাটক করা সম্ভব ছিল না। মনে হল গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য গ্রামেই কিছু করি।” শুরু হল গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছোট ছোট বিষয়ের উপর নাটক করা। ১৯৯৯ সালে এসে স্থায়ী দল তৈরি হল, ‘এবং আমরা’।
“এর পরই ঠিক করি একটি থিয়েটার ভিলেজ করতে হবে, যেখানে থিয়েটার নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারব।” ক্রমে কল্লোলবাবুর দলে নাম লেখালেন তাপস বাউরি, সুফি মোর্শাদুল, মানিক বাউরি, মিঠুন সরকার, গণেশ কোড়া, সোনালি বাউরি থেকে শুরু করে বাসুদেব গোস্বামী, তনুশ্রী ভট্টাচার্যকে নিয়ে মোট তিরিশ জন নাট্যকর্মী। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বালি খাদানে, কেউ ইটভাটায় আবার কেউ পরের জমিতে দিন-মজুরি করতেন। কেউ চাষবাস করতেন। প্রতিদিনের খাওয়া-পরার চিন্তা মাথায় নিয়ে পরীক্ষামূলক নাট্যচর্চা সম্ভব ছিল না। তার উপর সারাদিনের খাটুনির পরে ক্লান্তিতে ঠিক মতো রিহার্সাল করতেও সমস্যা হত। সেখান থেকেই এল নিজস্ব ফার্ম -এর ভাবনা।
এই মুহূর্তে থিয়েটার ভিলেজের ফার্ম থেকে প্রতি মাসে পোলট্রি, মাছ চাষ, ফলের বাগান মিলিয়ে ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। ফার্মের কাজ আর নাটকের কাজ নিয়ে একটা অন্য রকম জীবনের হদিশ দিয়েছে ‘তেপান্তর’। তাপস বাউরি আট বছর ধরে এই দলে আছেন। সপ্তম শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা করেননি। বাড়িতে চাষবাস হয়। তিনি আজ ‘তেপান্তরে’র এক জন নাট্যকর্মী। “যখন শুনলাম গ্রামে নাটকের দল হয়েছে, তখন এখানে আসতাম রির্হাসাল দেখতে। ভাল লেগে গেল। কল্লোলদাকে বললাম, আমিও থিয়েটার করব।” বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান অজিত ঘোষও বললেন, ছোট গ্রাম থেকে অনগ্রসর শ্রেণির ছেলেমেয়েরা নাটক করছেন, সেই নাটক দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসছেন,তাতে তাঁরাও গর্বিত এবং খুশি। ‘তেপান্তরে’র মতো আরও নাট্যগোষ্ঠী আশপাশের জেলাতেও তৈরি হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। |