এ বার ২০০ বছরে পড়ল কোচবিহারের রাসমেলা। রাজ আমলের ঐতিহ্যবাহী কোচবিহারে এই ঘটনাকে স্মরণীয় ও জমকালো করে রাখতে আরও নানা পরিকল্পনা হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজ বুধবার মেলার আয়োজক পুর-কর্তাদের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, পূর্ত, দমকল, পুলিশ সহ নানা দফতরের কর্তার নিয়ে বৈঠক করবেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা।
|
কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গাঁধী বলেন, “রাসমেলার সঙ্গে জেলার বাসিন্দার আবেগ জড়িয়ে। কোনও দিকথেকেই মেলার আয়োজনে খামতি রাখতে চাইছি না। এডিএম (উন্নয়ন) কে এ নিয়ে বৈঠক ডাকতে বলেছি।” কোচবিহারের অতিরিক্ত জেলাশাসক সুদীপ মিত্র বলেন, “বুধবার ব্যাপারে বৈঠক ডাকা হয়েছে।”
দু’দুটো সার্কাস, মৃত্যুকূপ, টয়ট্রেন, হরেক নাগরদোলা, দুই হাজারের বেশি রকমারি দোকান তো বটেই, কলকাতা ও মুম্বইয়ের খ্যাতনামা শিল্পীদের এনে জলসার বন্দোবস্ত হচ্ছে। অন্য বছর নির্দিষ্ট ১৫ দিনের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০ দিন করার চেষ্টা চলছে। জেলা প্রশাসন ও পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এবার ২৭ নভেম্বর থেকে রাসমেলা শুরু হচ্ছে। মেলায় এ বারই নজিরবিহীন ভাবে দুটি সার্কাস আনা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সার্কাস কোম্পানি মালিকদের সঙ্গে পুরসভার কর্তাদের চূড়ান্ত আলোচনা হয়ে গিয়েছে, নাগরদোলা, মৃত্যুকূপ, টয়ট্রেন, চিত্রহার প্রদর্শনী সহ অন্যান্য আকর্ষণ মেলায় আনার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। পুরসভার চেয়ারম্যান বীরেন কুণ্ডু বলেছেন, “দুশো বছরের রাসমেলাকে জমকালো করে তুলতে সবরকম চেষ্টা হচ্ছে। দুটো সার্কাস একসঙ্গে মেলায় তাঁবু ফেলবে।
কুমার শানু, বিনোদ রাঠোর সহ কলকাতা ও মুম্বাইয়ের তারকা শিল্পীদের রাসমেলার মঞ্চে অনুষ্ঠানের সূচি পাকা হয়েছে। এবার মেলার মেয়াদ ৫ দিন বাড়ানোর ব্যাপারে বুধবারের বৈঠকে প্রস্তাব দেওয়া হবে।” প্রশাসন সূত্রেই জানা যায়, কোচবিহার রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন দেবের রাসযাত্রাকে কেন্দ্র করে ফি বছর ওই মেলা বসে। কোচবিহার জেলা তো বটেই উত্তরবঙ্গ, নিম্ন অসম, নেপাল, ভুটান থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী, ব্যবসায়ী মেলায় আসেন। মেলা উপলক্ষে দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের উদ্যোগে মদনমোহন বাড়ি রঙ করা, মন্দির চত্বরে পুরনো কাহিনীর খন্ডচিত্রের পুতুল ঘর সাজানো, বিশাল চেহারার পুতনা রাক্ষসী তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাসমেলার দুশো বছর পূর্তি ঘিরে কোচবিহারের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ দেখা দিয়েছে। প্রবীণদের অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন। কোচবিহারের প্রবীণ বাসিন্দা, ইতিহাস গবেষক নৃপেন পাল বলেন, “রাজাদের আমলে রাসমেলা উপলক্ষে ২০ টাকা ভাড়া য় আগ্রহীরা বিমানে কোচবিহার শহরে দুবার চক্কর দিতে পারতেন। এখন সে সুযোগ নেই। তবে রাসমেলার জলুস এতটুকু কমেনি।”
কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “এক সময় রাসমেলা উপলক্ষে আলিপুরদুয়ার থেকে লালমণিরহাট স্পেশাল ট্রেন চলত। গরুর গাড়িতে গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসতেন। সময়ের বদলেও যাতায়াতের ধারা বদলালেও মানুষের বিপুল সমাগমের কোন বদল হয়নি।” দর্শনার্থীদের ওই বিপুল সমাগম এবার আরও বাড়বে বলে মনে করছে পুলিশ-প্রশাসন। কোচবিহারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমিত সিংহ বলেন, “মেলায় কড়া নজরদারি হবে।” বাড়তি লোক আসতে পারে বেভেই ক্লোজ সার্কিট টিভির সংখ্যা বাড়াবে পুলিশ।
|
• ১৮১২ সালে প্রথম রাসমেলার আয়োজন হয় ভেটাগুড়িতে। অগ্রহায়ণ মাসে রাসপূর্ণিমা তিথিতে মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ ভেটাগুড়িতে নব নির্মিত রাজপ্রসাদে প্রবেশ করেন। সেই উপলক্ষে রাসমেলা শুরু হয়।
• ওই প্রসঙ্গে জয়নাথ মুন্সীর রাজোপখ্যান গ্রন্থে বলা হয়েছে, বাংলা ১২২৯ সালে রাজবাড়ীতে অত্যন্ত ভৌতিক উপদ্রব হওয়ায় শ্রী শ্রী মহারাজ ...... ভেটাগুড়ি নামক নদীর ছড়ার মধ্যে নতুন রাজধানী ও অতিসুন্দর রাজবাড়ী নির্মাণ করাইলেন...... অগ্রহায়ণ মাসে কার্তিক পূর্ণিমার রাসযাত্রার দিবস সন্ধ্যাকালে ভূপতি স্বজনসহ নূতন আবাসে গমন করিলেন। শতক ২ সাওয়ারিতে অশ্বে ও গজে আরোহন করিয়া লোক চলিতে লাগিল। ... ... সেইখানেই রাসযাত্রা হইল।
• ১৮২১ সাল পর্যন্ত ভেটাগুড়িতে কোচবিহার রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৮২১ সালে কোচবিহার শহর লাগোয়া ধলুয়াবাড়িতে রাজধানী স্থানান্তর হয়। ১৮২৮ সালে রাজধানী কোচবিহার শহরে প্রত্যাবর্তন করে। অনেকের ধারণা পুরানো রাজবাড়িতে মদনমোহন বিগ্রহ থাকায় ওই বাড়ির চত্বরে মেলা হত। ইতিহাস গবেষকরা জানান, বর্তমান বৈরাগী দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর ১৮৯০ থেকে ওই মন্দির ও সমলগ্ন এলাকায় মেলা বসছে বলে অনুমান। ১৯১৭ সাল নাগাদ মেলার আয়তন বেড়ে যাওয়ায় ‘প্যারেড গ্রাউন্ডে’ মেলা স্থানান্তর হয়। রাসমেলার মাঠ নামে যা পরিচিত হয়ে উঠেছে। ১৯৭৩ সালে রাসমেলা উপলক্ষে পুরসভা প্রকাশিত বইয়ে ওই তথ্য রয়েছে।
• ১৯০৭ সালে টাউন কমিটি রাসমেলার দায়িত্ব নেয়। ১৯১২ সালে মেলার শতবর্ষ পূর্ণ হয়। তবে শতবর্ষ বলে বাড়তি জাঁকজমকের কথা সে ভাবে ছিল না বলে গবেষকদের একাংশ জানান। শহরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ায় ১৯২৩ সালে মেলা বন্ধ ছিল। গবেষকরা জানান, ১৯২৮ সালে মেলায় প্রথম বিদ্যুতের আলো ব্যবহার হয়। ১৯৬২ সালে চিনা আক্রমনের জেরে মেলা বন্ধ হওয়ার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত রাসমেলা বসেছিল। রাস উপলক্ষে রাসচক্র ঘোরার মত অনেক ঐতিহ্য বজায় থাকলেও ‘সর্ণা’ প্রথা উঠেছে। ওই প্রথা অনুযায়ী মেলার একটি দিন পর্দানসিন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সেদিন মেলায় প্রবেশাধিকার ছিল না।
• মেলা শুরু হচ্ছে ২৭ নভেম্বর। |