যত ওষুধ প্রয়োজন, পাওয়া যায় তার ৪০ শতাংশ। যে রেডিওথেরাপি যন্ত্র বেশ কয়েক বছর আগেই কার্যত বাতিলের পর্যায়ে চলে গিয়েছে, এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে সেই যন্ত্রগুলিই সবেধন নীলমণি। সকালে যিনি গলস্টোন বা অ্যাপেন্ডিক্স কেটে বাদ দেন, দুপুরে তাঁকেই করতে হয় অন্ত্র-ক্যানসারের জটিল অস্ত্রোপচার। এ ভাবেই চলছে ক্যানসার চিকিৎসা পরিকাঠামো। শিয়রে শমন, অথচ ন্যূনতম প্রস্তুতিটুকুও নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল বাদ দিলে রাজ্য সরকারি পরিকাঠামোয় কলকাতায় ক্যানসারের চিকিৎসা হয় মূলত কলকাতা মেডিক্যাল, এসএসকেএম, নীলরতন সরকার এবং আরজিকরে। মেডিক্যাল কলেজে একটি আলাদা ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র আছে ঠিকই। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই মানছেন, প্রয়োজনের তুলনায় পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব। বাকি হাসপাতালগুলির অবস্থা কী? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, যত ওষুধ প্রয়োজন তার বড়জোর ৪০ শতাংশ তাঁরা পান। এমনও হয় যে, কেমোথেরাপির একটা পর্যায়ের ওষুধ হাসপাতাল দিল। বাকি পর্বের ওষুধ রোগীর পরিবারকে জোগাড় করে আনতে বলা হল। না পারলে, কেমোথেরাপি অসর্ম্পূণই থেকে যাবে।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার নেই। নেই পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থাও। রেডিওথেরাপিতে এখনও আদ্যিকালের কোবাল্ট যন্ত্রই চালু। চিকিৎসকেরা মানছেন, যে কোনও উন্নত হাসপাতালে এখন রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে লিনিয়র অ্যাক্সিলারেটর যন্ত্র থাকার কথা। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কোবাল্ট যন্ত্রের চেয়ে লিনিয়র অ্যাক্সিলারেটরে রেডিওথেরাপি অনেক বেশি কার্যকরী হয়। সব হাসপাতালে সম্ভব না হলে অন্তত দু’তিনটি জায়গায় অবিলম্বে এই যন্ত্র আনা উচিত।”
করুণ অবস্থা ক্যানসারের শল্য চিকিৎসারও। যে চিকিৎসক গলস্টোন বা হার্নিয়া অস্ত্রোপচার করছেন, সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের জটিল অস্ত্রোপচারও তাঁকেই করতে হয়। শুধুমাত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ক্যানসার সার্জারির পৃথক ব্যবস্থা থাকলেও বিপুল চাহিদার তুলনায় তা নেহাতই নগণ্য। নীলরতন সরকার হাসপাতালের এক শল্য চিকিৎসকের আক্ষেপ, “জেনারেল সার্জারির কোর্সে ক্যানসার সার্জারির একটা অংশ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা স্রেফ বিষয়টাকে ছুঁয়ে যাওয়া। গভীর জ্ঞানের কোনও সুযোগ নেই।” বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “ক্যানসারের শল্য চিকিৎসাকে অন্য শল্য চিকিৎসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। এর পৃথক পাঠ্যক্রম রয়েছে।” |
এক ছাতার তলায় ক্যানসার চিকিৎসার সামগ্রিক ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার সামনে এসেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে টিমটিম করে একটি কেন্দ্র চলা ছাড়া অন্য হাসপাতালগুলিতে তেমন কোনও পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “এখানে যা রয়েছে তা হল কয়েকটা রেডিওথেরাপি ইউনিট আর কেমোথেরাপির ব্যবস্থা। আর তার উপরে ভিত্তি করেই পুরোটা চলছে।” ‘কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার ম্যানেজমেন্ট’ বলতে যা বোঝায়, তার ছিটেফোঁটাও এখানে নেই। এমনকী কয়েক মাস বয়সের শিশুর ক্যানসার ধরা পড়লেও যে ভাবে চিকিৎসা হবে, বয়স্কদের ক্ষেত্রেও তাই। “পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি বিভাগটাই নেই এখানে।”
অথচ রাজ্য সরকার কিন্তু নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়েই বসে রয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলিতেও ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে বলে একাধিক বার স্বাস্থ্য দফতরের তরফে দাবি করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “পরিকাঠামো নিয়ে কোথাও কোনও অভিযোগ নেই। ক্যানসার চিকিৎসা সব স্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। কলকাতা-নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা হচ্ছে।” কিন্তু প্রশ্ন হল, জেলার চিকিৎসা পরিকাঠামো ভাল হলে এখনও জেলা থেকে রোগীরা কলকাতায় আসছেন কেন? স্বাস্থ্য কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর নেই। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক বললেন, “কিছুই নেই। আমরা ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছি।” অথচ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলছেন, “কাজ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে সমস্ত ক্যানসার রোগীদের নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যত্রও ধাপে ধাপে এই ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবা হচ্ছে।”
আজ জাতীয় ক্যানসার সচেতনতা দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হুঁশিয়ারি অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি পরিবারে অন্তত এক জন করে ক্যানসার রোগী মিলবে। দেশ জুড়ে নানা ধরনের প্রতিরোধ কর্মসূচি চলছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই রোগের কাছে আগাম আত্মসমর্পণ করেছে। |