অস্ট্রেলিয়ায় শুক্রবার টোলগে ওজবের হাঁটুতে আর্থোস্কোপির পর কত দিন তাঁকে মাঠের বাইরে থাকতে হবে, তিনি আদৌ লাল-হলুদ জার্সির পুরনো ফর্মে ফিরতে পারবেন কি না তা নিয়ে মঙ্গলবার মোহনবাগান তাঁবুতে ছিল আশা আর আশঙ্কার চোরাস্রোত। পাশাপাশি ময়দান জুড়ে জোর আলোচনা সেই মিথ নিয়ে। টোলগের ঘটনার পর যে অরণ্যপ্রবাদ আরও জোরালো হয়েছে— ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে অন্য দলে গেলে শুরুতে সেই ফুটবলার ব্যর্থ হবেনই। পরে অবশ্য কেউ দুর্দান্ত ফর্মে ফিরেছেন, ভাল খেলেছেন। কিন্তু নতুন জার্সিতে শুরুটা ভাল হয়নি।
লাল-হলুদ জার্সি ছেড়ে গিয়ে সেই অরণ্যপ্রবাদকে সত্য প্রমাণ করার তালিকায় অসংখ্য নাম। মহম্মদ হাবিব থেকে সুরজিৎ সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা থেকে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় থেকে ভাইচুং ভুটিয়া কার নাম নেই সেখানে। সবার জীবনেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় শেষতম সংযোজন টোলগে।
১৯৭৫-এ মহমেডানকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করতে লাল-হলুদ জার্সি ছেড়েছিলেন মহম্মদ হাবিব। সঙ্গে ছিলেন ভাই আকবর। ইচ্ছে ছিল সাদা-কালো জার্সিতে টিমকে খেতাব দিয়ে ছেড়ে আসা দলের টানা ছ’বার লিগ জয় আটকানো। সেটা না পেরে শেষ পর্যন্ত মিঞা ভাইরা পরের মরসুমেই নাম লেখান মোহনবাগানে। রাগারাগি করে একঝাঁক ফুটবলারকে নিয়ে ১৯৮০-তে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে চলে গিয়েছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। ফেড কাপের দ্বিতীয় ম্যাচেই চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল নামী এই তারকা ফুটবলারকে। টোলগের মতোই হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল তাঁর। প্রায় বত্রিশ বছর পরেও সেই স্মৃতি সুরজিতের টাটকা। বলছিলেন, “প্রায় তিন মাস পর মাঠে ফিরেছিলাম বটে কিন্তু তার জন্য দিনে কুড়ি ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আমারও আথ্রোস্কোপি হয়েছিল। ভেঙে পড়িনি। তাগিদটাই মাঠে ফিরিয়ে এনেছিল।” পরে অনেকগুলো ট্রফি জিতলেও প্রথম দিকে চোটের জন্য বসে থাকতে হয়েছিল সুরজিৎকে। লাল-হলুদ জার্সি ছেড়ে গেলেই কেন এ রকম হয়? “আমি ঠিক ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখি না। আসলে ইস্টবেঙ্গল তো জনতার ক্লাব। তবে আমি এমন ফুটবলারের উদাহরণও দিতে পারি, যে ইস্টবেঙ্গলে ভাল খেলতে পারেনি মোহনবাগানে গিয়ে ভাল খেলেছে।”
সুরজিতের সঙ্গে পুরো সহমত নন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। মহমেডান থেকে সুরজিৎ পরের বছর চলে গিয়েছিলেন মোহনবাগানে। ভাস্কর ফিরেছিলেন লাল-হলুদেই। বলছিলেন, “এই ব্যাপারটা এত বার ঘটেছে যে অরণ্যপ্রবাদটা সত্যিই মনে হয়। মোহনবাগান বা মহমেডানকে আমি খারাপ বলছি না। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে কর্তা-সদস্য-সমর্থকদের মধ্যে কেমন যেন একটা অন্য রকম প্রাণ থাকে। ফুটবলাররা অন্য ক্লাবে গিয়ে সেটা পায় না বলে শুরুতে সমস্যা হয়। পরে মানিয়ে নেয়।”
টোলগে বারবার চোট পাচ্ছেন। ফেড কাপে তো পারেননিই, আই লিগেও বাগানকে কতটা সাহায্য করতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন। হয়তো পরে ভাল খেলবেন। অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকারের সঙ্গে দু’বছরের চুক্তি বাগানের। কিন্তু আপাতত শুরুতে তিনি ব্যর্থের তালিকায়। নাম লিখিয়েছেন শ্যাম থাপা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তরুণ দে, ভাইচুং ভুটিয়া, সুরকুমার সিংহদের দলে। ’৭৭-এ ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে গিয়েছিলেন শ্যাম। শুরুতে এতটাই খারাপ খেলেছিলেন দর্শকদের চাপে তাকে প্রথম একাদশের বাইরে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্লাব ফুটবলের সফলতম কোচ পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পরে অবশ্য তিনি প্রচুর ম্যাচ গোল করে জিতিয়েছেন। খেলোয়াড়জীবনের শেষ দিকে ১৯৯১-তে অভিমানে প্রিয় লাল-হলুদ জার্সি ছেড়ে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য চলে গিয়েছিলেন বাগানে। দু’বছর সেখানে থেকে সাফল্য পাননি। ফিরে এসেছিলেন পুরনো ক্লাবে। ’৯৫-তে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল আর এক ডিফেন্ডার তরুণ দে-র জীবনেও। ভারতীয় ফুটবলের আইকন ভাইচুংও ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে অনেক বেশি উজ্জ্বল মোহনবাগানের চেয়ে। আর আটের দশকের আর এক ফুটবলার দেবাশিস মিশ্র তো ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গিয়ে হারিয়েই গেলেন। টোলগের কী হবে? মোহন কর্তা-সমর্থকরা আশায়। ডার্বি ম্যাচে না হলেও পরে ফিরবেনই পেশাদার ফুটবলার। সুরজিৎ-ভাস্কররা ঠিকই বলছিলেন, “তাগিদ যদি থাকে, তা হলে টোলগে ফর্মে ফিরতেই পারে।”
|
ময়দানের ‘প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ’
ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে কলকাতার অন্য বড় ক্লাবে গেলে
শুরুটা কখনও ভাল হয় না... |
মহম্মদ হাবিব (১৯৭৫)
ইস্টবেঙ্গলের সামনে ষষ্ঠ বার লিগ জেতার সুযোগ থাকলেও আকবরকে নিয়ে মহমেডানে যান। কিন্তু মহমেডানকে লিগ জেতাতে পারেননি। |
|
শ্যাম থাপা (১৯৭৭)
ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম দিকে ব্যর্থ। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে প্রথম ম্যাচেই অপ্রত্যাশিত হার। |
|
সুরজিৎ সেনগুপ্ত (১৯৮০)
অনেককে নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইডেনের দ্বিতীয় ম্যাচে চোট পাওয়ার পর বিশেষ কিছু করতে পারেননি। |
|
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (১৯৯১)
রাগ করে ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগানে
যান ‘ঘরের ছেলে’। কিন্তু সুপার ফ্লপ।
দু’ বছর বাদেই প্রত্যাবর্তন। |
|
ভাইচুং ভুটিয়া (২০০৭)
ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে যান। কিন্তু
প্রথম দিকে পুরনো সাফল্যের ধারেকাছে
পৌঁছতে পারেননি। |
|
টোলগে ওজবে (২০১২)
চূড়ান্ত বিতর্কের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে। মরসুমের শুরুর দিকেই চোট পেয়ে অস্ত্রোপচারের সামনে। আট সপ্তাহ হয়তো বাইরে। |
|
|