বিতর্ক...
দাম্পত্যেও চালু হোক ‘ক্যাজুয়াল লিভ’
পক্ষে
দূরে গেলে একঘেয়েমি কাটে
বর্তমান যুগ, ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। সকল জায়া ও পতিরই নির্দিষ্ট একটি স্বতন্ত্র জগত থাকা উচিত। সেই জগতে বিচরণে উভয়েরই আলাদা পরিসর থাকা বাঞ্ছনীয়। বিয়ে হয়েছে বলে কি টাটকা অতীতটা ভুলে যেতে হবে নাকি? উভয়েরই উচিত (নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে) পুরনোদের সঙ্গে মাঝে মাঝে গেট-টুগেদার করা। এটা কিন্তু দাম্পত্যে দমকা বাতাস এনে দিতে পারে। দিন না মাঝে মাঝে এক দিন করে মা-বউদের ছুটি, কিংবা আমাদেরও নিজের মতো করে এক একটা দিন কাটাতে। তবে নিয়ম করে দাম্পত্যে ক্যাজুয়াল লিভ নেবেন, না উভয়ের মধ্যে রসায়নটা আর এক বার ঝালিয়ে নেবেন, সেটা তাদের ব্যাপার। আবার দাম্পত্যে ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে পরে যেন অস্বীকার করবেন না, এতে ‘সন্দেহ’ নামক এক প্রকার ছোট্ট চারা জন্মাবে, যারা কিনা আবার নানা বদগুণে অমর। তাই দাম্পত্যে সি এল অবশ্যই ভাল দিক, তবে উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়াটা লুকোছাপা না করে সেরে ফেলা উচিত।
দাম্পত্যে ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ চালু হলে দাম্পত্যের আকর্ষণ বাড়বে। কাছে থেকেও অনেক সময় দূর রচিত হয়। দূরে গেলে প্রতি পদে তখন মনে হবে, এসো কাছে। একঘেয়েমি কাটবে। ছোট ভুল বড় হয়ে দেখা দেবে না।
‘দাম্পত্যেও চালু হোক ক্যাজুয়াল লিভ’ অতি উত্তম প্রস্তাব। ভাল করে চিন্তা করলে দেখা যাবে বাস্তবে এটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বর্তমান ছিল, আছে এবং থাকবে। যেমন, স্ত্রী স্বামী-সন্তানের উপর অভিমানে ‘বাপের বাড়ি’ যাচ্ছি বলে চলে যায়। কয়েক দিন কাটিয়ে আসে। সেখানে আছে তার মা-বাবা, ভাই বোনেরা। তাঁরা ঠিক পরামর্শ দিয়ে বোঝান, ‘ছেলেটি অত খারাপ নয়, নিজের আচরণটা একটু খেয়াল কর’। তাতে প্রায়ই কাজ হয়। ‘স্ত্রী’ নামক অত্যন্ত স্পর্শকাতর মানুষটিরও মনে হয়, এতটা রাগ না-করলেও হত। পরের দিনই সব তল্পিতল্পা গুছিয়ে স্বামী ও সন্তানের কাছে ফেরত। গত ২৪ ঘণ্টায় সন্তানের ওজন কমল কি না, স্বামী ওষুধটা ঠিক মতো খেয়েছে কি না, তার বিস্তর চিন্তা ও স্নেহের বর্ষণ ঘটতে থাকে। স্বামীও বোঝেন, গৃহিণী নেই তাই তরকারিতে নুন দেওয়া কখন হয় জানে না। ছোট ছেলেটা কবে থেকে কী কী হোমওয়ার্ক করে যাচ্ছে তা জানা হয়নি। কোনটা প্রেশারের ওষুধ আর কোনটা ঘুমের ওষুধ তা জানতে প্রেসস্ক্রিপশনটা অনেক দিন পর ঘেঁটে বার করতে হয়। তার মনে হয়, আজ অফিসটা ঝঞ্ঝাটের হল শুধু ‘ব্রাউন শু’-তে কালো কালি লাগানোর জন্য। ক্যাজুয়াল লিভের অনেক গুণ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, অধিক ব্যবহারে এই মহামূল্যবান ‘লিভ’-এর উপযোগিতা হ্রাস পেতে পারে।
‘ক্যাজুয়াল লিভ’ আছে বলেই শ্রীশ্রী দুর্গা কৈলাস ছেড়ে বাপের বাড়ি আসেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে মামারাড়িতে তো আসেনই, যখন একলা আসেন তখন তাঁরা একটা করে ক্যাজুয়াল লিভ অতিরিক্ত হিসাবে পেয়ে থাকেন। কার্তিক ছাড়া বাকি সকলেই বিবাহিত। প্রতি দুর্গা সপ্তমীতে গণেশের সঙ্গে কলাবউয়ের বিয়ে হয়। তাই গণেশের ক্ষেত্রে এ দেশ যেমন তাঁর মামার বাড়ির দেশ, তেমনই শ্বশুরবাড়িও বটে। আর দেবদেবীরা যখন ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ পেয়েই থাকেন, তখন মানুষের পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধে কোথায়?
দাম্পত্য-জীবনে প্রবেশ করলে মেয়েদের সংসারে একটা স্থায়ী চাকরি জোটে ঠিকই, কিন্তু চাকরিটিতে না-আছে সম্মানদক্ষিণা, না-আছে ছুটি। এ দেশে দম্পতির মধ্যে গৃহকর্মে শ্রমবিভাজন নয়। গৃহিণীর একক দায় সকল গৃহকর্মের। উদয়াস্ত খেটেও কোনও দিন ছুটি পাওনা তো দূরের কথা, মর্যাদাও পাওয়া যায় না।

বিপক্ষে
সম্পর্কে আসবে যান্ত্রিকতা
বিষয়টি বেশ মজার। তবে আমি এর তীব্র বিরোধী। বর্তমানে দাম্পত্যজীবনে আইনের সরাসরি প্রবেশই দাম্পত্য বিরোধের এক ও একমাত্র কারণ। এতে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় মহিলা উন্নয়ন মন্ত্রক মন্ত্রীদের বেতন কী ভাবে স্বামীদের কাছ থেকে আদায় করা যায় তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভাল কথা ক্যাজুয়াল লিভ, স্ত্রীদের বেতন যদি চালু হয় তবে চাকুরিদাতা হিসাবে স্বামীরা দিনে টানা আট ঘণ্টা কাটিয়ে সুদে আসলে উসুল করে নেবেন। অকর্মণ্য বা অসুস্থ হয়ে গেলে স্ত্রীদের ছাঁটাই করে পেনশন দিয়ে দেবেন। তখন আর স্ত্রীরা স্বামীদের সম্পত্তির অধিকারিণী হতে পারবেন না। দুপুরে ভাত-ঘুম দিতে পারবেন না। টিভি দেখতে পারবেন না। শপিং মলে পিক-আওয়ারে যেতে পারবেন না। রাতে বাপের বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।
দাম্পত্যে আবার ‘ক্যাজুয়াল লিভ’-ই বা কী, ‘আর্নড লিভ’-ই বা কী?
কোনও দিন কাউকে দেখেছেন নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনশনে বসতে?
দাম্পত্য মানে বিশ্বাস, ভালবাসায় গড়া এক ধরনের পারস্পরিক নির্ভরতা। যতটা একসঙ্গে থাকা যায় ক্ষতি কী? নিজের সংসারে পুত্র, কন্যা, স্বামী, স্ত্রী সকলেই উপস্থিত। একা একা ক্যাজুয়াল লিভ না-নিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে ছুটিতে গেলেই ভাল হয়।
বিশ্বায়নোত্তর যুগের নিউক্লিয়াস ফ্যামিলিগুলোতে সম্পর্কের উষ্ণতা বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তাই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলিকে নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির দিকে ঠেলে দেয় এমন আইন প্রবর্তন করা থেকে আমাদের বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। দুটি মানুষের (সেম সেক্স বা অপোজিট সেক্স) মনের মিলন, ভালবাসা-বিশ্বাস- বোঝাপড়া ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এই মধুর পবিত্র সম্পর্ক। একজন সঙ্গীর সীমাবদ্ধতা এক্ষেত্রে অন্য জন স্বাভাবিক নিয়মেই পুরণ করে দেয়। এর জন্য কোনও আইনের প্রয়োজন এখনও হয়নি। ‘দাম্পত্য’ একটি সম্পর্ক এবং সম্পর্কের মধ্যে সাময়িক বিরতি (ক্যাজুয়াল লিভ) বলে কিছু হয় না। সাংসারিক কাজের ক্ষেত্রে যদি কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ ঠিক করে দেওয়াও হয় এবং তার থেকেও বেশি দিনের বিরতির প্রয়োজন হয়, তবে কি চালু করতে হবে ‘আনর্ড লিভ’ বা ‘মেডিক্যাল লিভ’? আর তার পরেও ছুটির প্রয়োজন হলে ‘আনঅথরাইজড লিভ’ দেখিয়ে বেতন কেটে নেওয়া হবে? অধুনা আলোচিত বিলটি পাশ হয়ে গেলে অর্ধাঙ্গিণীকেও হাউস-মেকার হিসাবে বেতন দিতে হবে। এগুলি কি সম্পর্কের মধ্যে যান্ত্রিকতাকেই প্রশ্রয় দেবে না? মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়াই সনাতন ভারতবর্ষে তথা আজকের ভারতবর্ষে মায়েরা সাংসারিক কাজ করে বা না-করে সুস্থ ভাবে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। ব্যতিক্রমী পরিবারও আছে, তবে সেখানে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে, বেতন চালু করা, ছুটি চালু করা এগুলি প্রফেশনালিজমকেই উৎসাহিত করে। যা কখনওই দাম্পত্যের ভিত্তি নয়।
বর্তমানে দাম্পত্যজীবন নানা সমস্যা ও অশান্তিতে দোদুল্যমান। তাই দাম্পত্যের ঘোষণা বা সুপারিশ ছাড়া আইন দুটি (ক্যাজুয়াল লিভ) চালু হলে অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। এমনিতেই কাজের চাপে এবং অণু-পরিবারের পরিবেশে দম্পতিদের দাম্পত্যলীলা প্রকাশের সময় কম তার উপর ছুটি চালু হলে সন্দেহ এবং সংসারের পড়ে-থাকা কাজের চাপ অবশ্যই বাড়বে। বর্তমান জগতে বিকর্ষণ আকর্ষণের প্রকাশ ঘটায় না। বরং সন্দেহ বা বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে সন্তান প্রসব হেতু দম্পতিরা কিছু কাল ছাড়াছাড়ি থাকতেন। তার একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে দাম্পত্যে সাবধানী হয়ে চলাই যুক্তিযুক্ত।

ডিসেম্বর মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ নভেম্বরের মধ্যে এই ঠিকানায়
ডিসেম্বর মাসের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.