মণিপুর হইতে সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ইরম শর্মিলা চানুর অনশনের বারো বছর অর্থাৎ এক যুগ পূর্ণ হইল। এত দীর্ঘ কাল অনশনে বাঁচিয়া থাকা যায় না। কিন্তু সরকার তাঁহাকে গ্রেফতার করিয়া বলপূর্বক তাঁহার শরীরে খাদ্যসামগ্রী প্রবেশ করাইয়া তাঁহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। একজন প্রতিবাদীকে এ ভাবে বাঁচাইয়া রাখার মধ্যে সরকারের মহানুভবতা খুঁজিতে যাওয়া অবশ্য অর্থহীন। বরং শর্মিলার দাবি শিরোধার্য করিয়া সরকার যদি বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করিয়া দিত, তবে সেটা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের একটি সদর্থক ক্রিয়া রূপে শংসিত হইত। কিন্তু তেমন কোনও সম্ভাবনা এ যাবৎ দেখা যায় নাই। জঙ্গি সন্দেহে যথেচ্ছ গ্রেফতারের, জিজ্ঞাসাবাদের, সত্যানুসন্ধানের নামে ধৃতদের অত্যাচার করার, এমনকী ‘সংঘর্ষে নিহত করা’র জবাবদিহির দায়মুক্ত অধিকার এবং সে অধিকার অপব্যবহারের জন্য দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার সম্মুখীন না-হওয়ার ছাড়-সংবলিত এই দমনমূলক ‘কালা কানুন’টি বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।
তাহাতে কি ইরম শর্মিলা চানুর আপসহীন সংগ্রাম ও অনমনীয় সংকল্পবদ্ধতার পরাজয় হইয়াছে? প্রশ্নটা শর্মিলার জয়-পরাজয়ের নয়। সত্য, তিনি এখনও প্রধানত নিঃসঙ্গ পথিক। দূর হইতে তাঁহাকে নমস্কার করিলেও, তাঁহার সাহস ও সঙ্কল্পের ভূয়সী প্রশংসা করিলেও, দেশবাসী তাঁহার দাবি মানিয়া লইতে সরকারকে বাধ্য করিতে আগাইয়া আসে নাই। কিন্তু তাহাতে শর্মিলার আদর্শ ও নীতির কোনও পরাভব ঘটে নাই। বরং তাঁহার এই অহিংস, একক, সংবেদনশীল, বিবেকী প্রতিবাদ রাষ্ট্রকে ক্রমাগত অস্বস্তিতে ফেলিতেছে। সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইনের অসারতা ও অকার্যকারিতাও উত্তরোত্তর স্পষ্ট হইতেছে। দেশবাসী দেখিতেছেন, মণিপুরে জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ প্রশমিত হওয়ার কোনও লক্ষণ নাই। তাঁহারা উপলব্ধি করিতেছেন, দমনমূলক ওই আইনের জোরেই অসম রাইফেল্স-এর জওয়ানরা দেশবাসীরই একাংশের সহিত দখলদার বিদেশি বাহিনীর ন্যায় আচরণ করিতেছে। এই আচরণের বিরুদ্ধে মণিপুরের মায়েদের ‘বিবস্ত্র প্রতিবাদ’ ইতিমধ্যেই মানবাধিকার আন্দোলনের নাগরিক লোকগাথার অন্তর্ভুক্ত হইয়া আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ধিক্কৃত, ভর্ৎসিত হইতেছে। ইহাতে বিদেশে মনমোহন সিংহ সরকারের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হইতেছে, এমন বলা যাইবে না। সুতরাং শর্মিলার একক প্রতিবাদ নিষ্ফল হইয়াছে, এমন নয়।
সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করিয়া লওয়ার সময় আসিয়াছে। গণতন্ত্রে নাগরিকের প্রতিবাদ করার, সরকার-বিরোধী আন্দোলন করার যে অধিকার থাকা উচিত, তাহার সীমান্তও যত দূর সম্ভব প্রসারিত করা দরকার। জনজাতীয় আত্মশাসনের দাবি প্রায়শ জঙ্গি সন্ত্রাসের পথে আত্মপ্রকাশ করিলেও তাহাকে সমান নিষ্ঠুরতায় ফৌজি দমননীতি মারফত শায়েস্তা করিতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে জনজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের কঠোর দমননীতি এ যাবৎ ওই সকল জনজাতির অনাস্থা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছাড়া কিছুই অর্জন করিতে পারে নাই। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রান্তিক ওই জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে নয়াদিল্লির শাসকদের সম্পর্কে যে ইতিবাচক মনোভাব ছিল, তাহা আজ অন্তর্হিত। শর্মিলা চানুর মতো বিবেকের সৈনিকরা তথাপি একটি সুযোগ খোলা রাখিয়াছেন জনজাতীয়দের বিরূপতা ঘুচাইয়া তাঁহাদের কাছে টানার, মন জয় করার সুযোগ। সেনাবাহিনীর উদ্যত সঙিন নয়, শর্মিলার অহিংস সংগ্রামই নয়াদিল্লির সহিত ইম্ফল বা কোহিমার সেতুবন্ধ রচনা করিতে পারে। দমনমূলক কানুন রদ হইলে শর্মিলাই হইতে পারেন যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যস্থতাকারী। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। সম্ভাবনারও। রাজনীতিকরা দৈনন্দিন তরজা ছাড়িয়া সেই শিল্পের চর্চায় মন দিলে ভাল হয়। |