ঈদ, দুর্গাপুজো, ইদুজ্জোহা, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা, মহরম। টানা এই উৎসবের মরসুমে সীমান্তের বাজারগুলোর পাশাপাশি জমজমাট প্রত্যন্ত হাটগুলোও।
ঈদ-উল-ফিতরে বাবার কাছে একটা আনারকলি চুড়িদার চেয়েছিল তেহট্টের সাকিলা খাতুন। হাতে তেমন টাকাপয়সা না থাকার কারণে তখন মেয়ের আবদার রাখতে পারেননি আসমত সেখ। তবে ইদুজ্জোহাতে তিনি মেয়েকে সেই চুড়িদারই কিনে দিয়েছেন। আসমত বলেন, “প্রথম যখন মেয়ে একটি চুড়িদার আবদার করল, তখন হাতে পয়সা ছিল না। ও দিকে জমির পাটও দাঁড়িয়েছিল জমিতেই। তারপর পাট উঠতেই আর অন্য কিছু ভাবিনি। প্রথম ঈদে না পারলেও পরে ইদুজ্জোহাতে বাড়ির সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কিনেছি।’’ সামনে মহরম। তাতেও তিনি ভালই বাজার পাবেন আশা করেন।
অন্য দিকে এ বারের পুজোয় বোনেদের জন্য কিছু কিনতে পারেননি কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত অনন্য সরকার। অনন্য বলেন, “পুজোর আগে আগে একটা ল্যাপটপ কিনতে গিয়ে বেশ কিছু খরচ হয়ে গিয়েছিল। ফলে পুজোর সময় বোনেদের জন্য কিছু কেনা হয়নি, তবে ভাইফোঁটাতে ওদের জন্য ভাল কিছু কিনব।” পিঠোপিঠি এই উৎসবগুলো হওয়াতেই আসমত বা অনন্যকে খুব বেশিদিন মনখারাপ করে থাকতে হচ্ছে না। আর এর প্রভাবটা পড়ছে বাজারগুলোতেও। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এ বারে প্রথম দিকে বৃষ্টি না হওয়াতে উৎসবের মরসুমের আগে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, কিন্তু পরের দিকে আকাশে মেঘ জমতেই মন থেকে সরে গিয়েছিল দুশ্চিন্তার মেঘও। তা ছাড়া এবার বৃষ্টিটা যেমন দেরিতে হয়েছে, তেমনই উৎসবগুলোও এ বার অনেকটা পিছিয়ে হয়েছে।
|
পাটের বাজার ও ‘মিসড কল’
করিমপুরের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “ধরুন প্রথম ঈদের আগে কেউ পাট কাটতেই পারেননি। কিন্তু পুজোর আগে পাট ঘরে তুলে ফেলেছেন। এ বার আগের ঈদের বাজারটা তিনি সেরে নিলেন ইদুজ্জোহার সময়। সব মিলিয়ে ব্যালান্সটা কিন্তু ঠিকই থাকল।” গত কয়েকবছরে সীমান্তের এই বাজারগুলোতে ব্র্যান্ডের পোশাকের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে তাছাড়াও টিভি সিরিয়াল ও বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে বেশ কিছু পোশাক, চুড়িদার, শাড়ি কিংবা জুতোও বেশ কিছু নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেই মত ব্যবসায়ীরা অন্য ব্র্যান্ডের পোষাকের পাশাপাশি রেখেছিলেন ঝিলিক কিংবা আনারকলি চুড়িদার, বাহা, জারদৌসি, ইক্কত বা কাঞ্জিভরমের মতো শাড়ি কিংবা ঢাকাই জামদানি। তা ছাড়া ন্যারো জিন্সের সঙ্গে ছেলেদের কুর্তা ও বাচ্চাদের জন্য বেনটেন পোশাকেরও এ বারের পুজো কিংবা ঈদে ছিল ভালই চাহিদা। মেয়েদের জুতোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল মিসড কল। করিমপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি তথা নদিয়ার চেম্বার অফ কমার্সের সহ সভাপতি বিধান দত্ত বলেন, “টানা এই উৎসবের মরসুমে সদর কিংবা সীমান্তের বাজারগুলোও চাঙ্গা ছিল। তবে লক্ষ্মীপুজো ও কালীপুজোর মাঝের এই সময়টাতে বাজার কিছুদিন থম মেরে থাকে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এরপর রয়েছে কালীপুজো, ভাইফোঁটা। তারপরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে বিয়ের মরসুম। তখন বাজার আবার তেজি হয়ে উঠবে। তবে এবারে ঈদ, পুজো এবং ইদুজ্জোহা টানা এই উসবের মরসুমে ভালোই বেচাকেনা করেছেন করিমপুর ও আশপাশের বাজারের ব্যবসায়ীরা।”
ভিড় বাড়ছে ‘ক্লান্ত’ হাটেও
এখন সীমান্তের বাজারগুলো ফের অপেক্ষায় রয়েছে পরবর্তী উৎসবের মরসুমের জন্য। সদ্য পেরোনো পিঠোপিঠি দুই উৎসবের পর বাজার এখন অনেকটাই ‘ক্লান্ত’। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানগুলো ছাড়া বেশিরভাগ দোকানেই ক্রেতাদের সেই চেনা ভিড় এখন উধাও। করিমপুরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী বিমান মণ্ডল বলেন, “এ বার পুজো কিংবা ঈদের সময় বাজার চাঙ্গা ছিল, এখন কিন্তু বাজার খারাপ। কালীপুজো থেকে বাজার আবার উঠতে শুরু করবে।” করিমপুরের এক জুতো ব্যবসায়ী প্রীতম সাহা যেমন বলেন, “ঈদ থেকে টানা ইদুজ্জোহা পর্যন্ত চুটিয়ে ব্যবসা করেছি। পুজো এবং ইদুজ্জোহা যেহেতু এবার পিঠোপিঠি ছিল, তাই ক্রেতাদের ভিড়ে দশমীতেও দোকান খুলে রাখতে হয়েছিল।” বাজারগুলোর পাশাপাশি এই উৎসবের মরসুমে জমিয়ে ব্যবসা করেছেন হাটের ব্যবসায়ীরাও। ডোমকল মহকুমার কুপিলা, কাঁটাকোবরা, গড়াইমারির হাটগুলোতেও যথেষ্ট ভিড় হচ্ছে। হাটের বিক্রেতারা জানাচ্ছেন বাজারে যেমন অনেকেই যান তেমনি হাটেরও কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা আছেন। ঈদ কিংবা পুজোতে পোষাক থেকে শুরু করে জুতো, মুদিখানার জিনিসপত্র সবই হাটে বিক্রি হয়।
আবহাওয়া উন্নতির আশা
কুপিলা হাটের মালিক মইদুল বিশ্বাস যেমন বলেন, “আমাদের এখানে বাজারের মতো হাটও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সাপ্তাহিক কেনাকাটা তো বটেই, ঈদ, দুর্গাপুজো এমনকি বিয়ের জন্য যাবতীয় জিনিসপত্রও কেনাবেচা হয় হাটেই। এ বারের ঈদ, দুর্গাপুজো, ইদুজ্জোহার মত উৎসবগুলি টানা হওয়াতে হাটের ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট ভাল ব্যবসা করেছেন।” তবে তাঁদের মত, এই ফাঁকা সময়টাতে বাজার এমনিতেই খারাপ যাচ্ছে, তার উপরে এই দু’দিনের মেঘলা আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে যা একটু কেনাবেচা হচ্ছিল, সেটাও হচ্ছে না। করিমপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী পুরুষোত্তম বিশ্বাস বলেন, “এমন আবহাওয়ায় খুব প্রয়োজন ছাড়া তো লোকজন তেমন বাইরেই বেরোচ্ছেন না, ফলে আবহাওয়ার জন্য ক্রেতা একেবারেই কমে গিয়েছে। সেই কারণে গত দু’দিন দোকানও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।” এই আবহাওয়াটা কেটে গেলেই রোদ ঝলমলে আকাশের ফের দেখা মিলবে। আর তারপরেই শুরু হবে ফের শুরু হবে উৎসবের মরসুম। আপাতত সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনছে সীমান্তের বাজার-হাট। |