ইতিহাসের মুঠো মুঠো হিরে, আর গোছা গোছা মোহর। স্মৃতির ঝাঁপিটা তবু বন্ধই রাখতে হচ্ছে সমর মুখোপাধ্যায়কে।
কাল, বুধবার শতবর্ষে পা রাখার সন্ধেয় বড়জোর শিশুর মতো খলখল করে হাসবেন তিনি। ক’দিন আগে যে হাসি দেখে শেক্সপিয়রের কবিতা মনে পড়ছিল বিমান বসুর। শেষ বয়সে মানুষ সত্যিই দ্বিতীয় শৈশবে ফিরে যায়! কী অকাট্য কথা বলেছিলেন শেক্সপিয়র!
একদা সিপিএমের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা সমরবাবু বাঙালির শতায়ু ক্লাবের নতুন সদস্য হতে চলেছেন। আর এক জলজ্যান্ত শতায়ু বঙ্গসন্তান মনোহর আইচের চেয়ে এক বছর আট মাসের ছোট। ক’মাস আগে একটি বিদেশি টিভি চ্যানেলের ডাকে ‘পকেট হারকিউলিস’ মনোহরবাবু দিল্লি ঘুরে এসেছেন। ধরে-ধরে এখনও টুকটুক করে চলা-ফেরা করেন। “তবে বাবার স্মৃতিশক্তিটা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। সে দিন মায়ের নাম মনে করতে পারছিলেন না।” বললেন মনোহরবাবুর কন্যা বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।
|
সমরবাবুও ঘরের মধ্যে সাহায্য নিয়ে একটু-আধটু হাঁটেন। কিন্তু মস্তিষ্কের বয়সজনিত ক্ষয়ের কারণে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত বাক্য উচ্চারণ ছাড়া প্রায় বাক্স্তব্ধই বলা যায়। ন’নম্বর দিলখুসা স্ট্রিটে কলকাতায় সিপিএমের শেষতম কমিউনে তাঁর প্রতিবেশী কেশব পাহাড়ির কথায়, “সমরদাকে পুরনো কথা বেশি মনে করাতেও ডাক্তারবাবুরা বারণ করেন। ব্রেনে চাপ পড়তে পারে।”
ঘটনাচক্রে, সমরবাবুর একশোয় পদার্পণের আগের দিনই দিল্লিতে বয়স্কদের পরিচর্যায় কর্মসূচি গড়ার লক্ষ্যে সম্মেলন ডেকেছে কেন্দ্র। যেখানে যোগ দিতে গিয়েছেন বাধর্ক্যবিজ্ঞান বিশারদ (জেরন্টোলজিস্ট) ইন্দ্রানী চক্রবর্তী। তিনি বলছিলেন, “শুধু দীর্ঘ জীবন নয়। কী ভাবে বেঁচে আছি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।” চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে সিনেমার সুবাদে আমবাঙালি সদ্য জেনেছে সূর্য সেনের শিষ্য ১০৩ বছরের বিনোদবিহারী চৌধুরীর কথা। এখনও শরীরে-মনে বেশ পোক্ত বিনোদবিহারী চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে ছবিটি দেখতে চান!
দীর্ঘজীবীদের মধ্যেও এমন দৃষ্টান্ত সহজলভ্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনদায়ী ওষুধের সৌজন্যে আয়ু এখন ঢের বেড়েছে। একশো বছর বা কাছাকাছি বাঁচার পিছনে অবশ্য জিনগত বৈশিষ্ট্যের যোগ থাকে। হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদিও থাকা চলবে না। কতটা স্বচ্ছন্দ ভাবে এক জন প্রবীণ মানুষ বাঁচছেন, সেটাও খেয়াল রাখা চাই। মনোহরবাবু বা সমরবাবুদের বয়সে মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে করেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ তৃষিত রায়, যিনি দীর্ঘ দিন সমরবাবুর চিকিৎসা করেছেন। তাঁর কথায়, “নব্বইয়ের পরে প্রায় সকলেই ভুলে যান বা অগোছালো কথা বলেন। অবশ্য পাঁচ বছর আগেও সমরবাবুকে দেখে এ সব মনে হতো না।” ঠিক কী ভাবে যত্নে রাখা উচিত প্রবীণতম নাগরিকদের? |
কী খান |
সকাল ৭টা
হরলিক্স-কমপ্ল্যানে ভিজিয়ে ২-৩টে
সেঁকা পাঁউরুটি, সিঙ্গাপুরি কলা |
সকাল ৮টা
লিকার চা |
সাড়ে ১২টা
গলা ভাত, উচ্ছে সেদ্ধ, ঘন মুগ ডাল, অল্প আলুভাতে,
পেঁপে দিয়ে মাছের ঝোল,
কদাচিৎ ২-৩ টুকরো মুরগি, মিষ্টি |
বিকেল ৫টা
চিনি দিয়ে আপেল সেদ্ধ |
সন্ধ্যা ৬টা
লিকার চা |
রাত পৌনে ১০টা
চিনি-হরলিক্স দিয়ে একটু দালিয়া সেদ্ধ |
|
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমিতে স্নায়ুরোগের ইতিহাস-বিষয়ক গবেষক সৌমিত্র বসু জোর দিচ্ছেন অতিবৃদ্ধ বা বৃদ্ধাটিকে ঘিরে হাসি-খুশি পরিবেশ তৈরিতে। তৃষিতবাবুর কথায়, “ওঁর বিশ্রামের অসুবিধে না-করে অন্যেরাও কাছে থাকুন। ওঁর ঘরেই বাচ্চারা খেলুক, হাসুক!” অকৃতদার সমরবাবু যুবা বয়স থেকে পার্টি কমিউনের বাসিন্দা হলেও সেখানে এমন সহৃদয় পরিবেশই পাচ্ছেন। পাশের ঘরে থাকেন দলীয় কর্মী কেশববাবু। যাঁর কিশোরী কন্যা দীপার ‘দাদু’ সমরবাবু। নাতনি এসে খুনসুটি করে, আপেল সেদ্ধ খাওয়ায়। পরিচর্যায় দলের তরফে দিন-রাতের আয়া। পরিবেশও পরিচ্ছন্ন।
বিমানবাবু বলছিলেন, “দু’বছর আগের জন্মদিনেও সমরদা কত গল্প করেছেন! পরে মুখের একটা দিক অসাড় হয়ে যায়। চিকিৎসায় সেরে উঠেছেন।” কয়েক মাস আগে প্রকাশ ও বৃন্দা কারাট দেখতে এসেছিলেন। প্রকাশের নাম বলতে পেরেছিলেন। বৃন্দাকে চিনেও নাম বলতে পারেননি। খবরের কাগজের লেখা বিনা চশমায় দেখতে পান। যদিও খুব বেশি পড়তে পারেন না। কথাবার্তা যৎসামান্য।
বরাবরের মিতভাষী মানুষটি কিন্তু পঁচাশি-ছিয়াশি বছরেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। তখন ব্যাগ হাতে ছুটে ওভারব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন ধরেছেন সিপিএমের ‘পার্টি-আদালত’ কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান সমরবাবু। ২০০৮-এর দলীয় সম্মেলনে কোয়ম্ববত্তুর, এক বছর বাদে দিল্লি সফর করেছেন। দেড় বছরের ছোট জ্যোতি বসুর প্রয়াণের পরে প্রথম মালাটি দিতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়েছিলেন। এর পরে আলিমুদ্দিনে পা আর এক বার রাজ্য কমিটির সম্মেলনে। নব্বইয়ের পরে পেসমেকার বসলেও সাতানব্বই-আটানব্বই বছর পর্যন্ত ছিলেন দিব্যি সচল, সবাক।
দীর্ঘ দিন এমন সক্রিয় ভাবে বেঁচে থাকার রহস্যটা কোথায়? |
সেঞ্চুরির দৌড়ে |
বিজয়া রায় ৯৫ |
স্বামী আত্মস্থানন্দ ৯৩ |
অমলা শঙ্কর ৯৩ |
মান্না দে ৯৩ |
রবি শঙ্কর ৯২ |
রমাপদ চৌধুরী ৯০ |
|
এখানে মনোহর আইচের সঙ্গে সমর মুখোপাধ্যায়ের যারপরনাই মিল। বিশ্বশ্রীর মতো নব্বই ইস্তক পান্তাভাতের ‘ডায়েট’ না-মানলেও মার্কসবাদী নেতাটির মূলমন্ত্রও সংযম। চুনো মাছ, সন্দেশ ভালবাসলেও বাড়াবাড়ি নয়। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। ধূমপান-মদ্যপানের প্রশ্ন নেই। মনোহরবাবুর মতো নিয়ম করে আট ঘণ্টার ঘুম অবশ্য পোষাতো না। স্কুল-জীবনেই জেলখাটা স্বাধীনতাসংগ্রামী। চিরকাল গভীর রাত পর্যন্ত বইটই পড়েও কাকভোরে বিছানা ছাড়তেন। আরও একটা জায়গায় সমরবাবু স্বতন্ত্র। “কাকাকে কখনও এক ফোঁটা রাগতে দেখিনি।” বলছেন ভাইপো প্রত্যূষ মুখোপাধ্যায়, বাম আমলে যিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন।
কৃতী বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রতি শতকের দোরগোড়া ছুঁয়েছিলেন লীলা মজুমদার ও নীরদচন্দ্র চৌধুরী। অল্পের জন্য ব্যর্থ অন্নদাশঙ্কর রায় (৯৮), স্বামী ভূতেশানন্দ (৯৭) ও স্বামী রঙ্গনাথানন্দ (৯৭)। রাজনীতিকদের মধ্যে সেঞ্চুরির কাছে আসায় বামপন্থীদেরই জয়জয়কার। যেমন, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (৯৭) বা জ্যোতিবাবু (৯৬)।
প্রথম শতক ছোঁয়া নেতা সমরবাবুর এই জন্মদিন স্মরণীয় করে রাখতে চায় তাঁর দল। প্রথা ভেঙে কমরেডের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পার্টি সম্পাদক কারাট, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দিলখুসা স্ট্রিটে দেখা যাবে। কেক কাটার ঘটা না-থাকলেও রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু ‘সমরদা’র জন্য পায়েস রেঁধে আনতে চান। বিশ শতকের ইতিহাসের সাক্ষী এক বর্ণময় জীবন নিয়ে আলোচনার পরে একটা সন্দেশ ও পায়েস হয়তো একটু দেওয়া হবে ‘বার্থডে বয়’কে।
সাবধানী আহারে ছাড় এটুকুই। হাজার হোক, শততম জন্মদিন দেখা আর ক’জনের জীবনে ঘটে! |
ভারতে বার্ধক্য |
২০০১
৭.০৭ কোটি
(৭.৫%) |
২০১১
৯.০৬ কোটি
(৮.২%) |
২০২১ (সম্ভাব্য)
১৩.০৩ কোটি
(৯.৯%) |
রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, ৭%-এর বেশি ষাটোর্ধ্ব নাগরিক
থাকলেই সেই দেশ বয়স্ক দেশ সাব্যস্ত হবে। |
(সূত্র: জনগণনা দফতর, ন্যাশনাল
স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন) |
|