বাড়ির সামনের উঠোনে হাসিহাসি মুখে বসেছিলেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধা। দিন কয়েক পরেই সপরিবারে বাড়ি ফেরার কথা বড় ছেলের। তাই মনটা তাঁর বেশ ফুরফুরে। বৃদ্ধার অবশ্য তখনও জানা ছিল না, কালীপুজোয় নয়, সোমবার রাতেই বাড়ি ফিরছে তাঁর বড় ছেলে। হেঁটেচলে নয়, কফিন-বন্দি হয়ে।
রবিবার সকালে ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়ায় মাওবাদীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ওই বৃদ্ধার বড় ছেলে পরেশনাথ চট্টোপাধ্যায়। দন্তেওয়াড়ার আকাশনগরে সিআইএসএফের হেড কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন বছর একান্নর পরেশবাবু। বাড়িতে খবর পৌঁছেছিল সে দিনই। তবে মা বাসন্তীদেবীকে তা জানাননি ছোট ছেলে বীরেশবাবু ও তাঁর পরিবার। সোমবার গভীর রাতে দেহ পৌঁছয় বাড়িতে। তার আগে দুপুরে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বীরেশবাবু অসহায় প্রশ্ন, “মাকে কী ভাবে সামলাব বলতে পারেন?” |
প্রায় ২৮ বছর সিআইএসএফে কর্মরত ছিলেন পরেশবাবু। আকাশনগরে ছিলেন বছর তিনেক। তাঁর স্ত্রী ছন্দাদেবী ও একমাত্র ছেলে চিন্ময় থাকেন মধ্যপ্রদেশের ভিলাইয়ে সিআইএসএফ আবাসনে। চিন্ময় সেখানেই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ফি বছর গরমে বাড়ি ফিরতেন পরেশবাবু। এ বারও এসেছিলেন। কালীপুজোতেও বাড়ি ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, সপরিবার কাটোয়ায় আসবেন বলে কর্মস্থলে দরখাস্তও করেছিলেন পরেশবাবু। তাঁর মামা শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “সেই প্রতিশ্রুতি আর রাখা হল না।”
পরিবার সূত্রে জানা যায়, মাস দেড়েকের মধ্যে আকাশনগর থেকে শোনপুরে বদলি হওয়ার কথা ছিল পরেশবাবুর। রবিবার সকালে আকাশনগর পোস্টের কাছে বেলাভিলা পাহাড়ে আরও পাঁচ জওয়ানের সঙ্গে কর্মরত ছিলেন তিনি। পুলিশের দাবি, কুয়াশার সুযোগ নিয়ে সকাল ৮টা নাগাদ মাওবাদীদের একটি দল হামলা চালায়। মাথায় ও পেটে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় পরেশবাবুর। আরও দুই জওয়ানকে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃত্যু হয় এক জনের। সোমবার রাতে পরেশবাবুর দেহ পৌঁছয় খেঁড়ুয়া গ্রামে।
বৃদ্ধা মাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জানানো না হলেও দুঃসংবাদ পেয়েছেন প্রতিবেশী ও পরিজনেরা। তবে বাড়িতে কাউকে যেতে দিচ্ছিলেন না বীরেশবাবুরা। বীরেশবাবু বলেন, “আমরা সবাই বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মায়ের সামনে যাচ্ছি না। যদি কিছু আঁচ করে ফেলে। আত্মীয়-স্বজনকে খবর পাঠিয়েছি। তাঁরা আসার আগে মা খবর পেয়ে গেলে আমার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়।”
পড়শিদের থেকে জানা গেল, পরেশবাবুদের কষ্ট করে বেড়ে ওঠার কথা। তাঁরা জানান, এক সময়ে দিনমজুরিও করতে হয়েছে পরেশবাবুকে। তিনি চাকরি পাওয়ার পরে পরিবারের হাল ফেরে। বীরেশবাবুর স্ত্রী শম্পাদেবী বলেন, “আমাকে বোনের মতো ভালবাসতেন। যখনই বাড়ি ফিরতেন আমার ছেলে মৃন্ময়ের জন্য কত কিছু আনতেন।”
টিনের চাল মাটির বাড়ির সামনের উঠোনে বসেছিলেন বাসন্তীদেবী। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করতেই পাশ থেকে হাত টেনে ধরে বছর আটের মৃন্ময় বলে, “ছবি তুলো না। ঠাম্মা বুঝে ফেলবে। হাসিটা বন্ধ হয়ে যাবে।” সন্ধ্যায় আত্মীয়েরা আসার পরে অবশ্য দুঃসংবাদ জানানো হয় বাসন্তীদেবীকে। কান্নার রোলে স্তব্ধতা নেমে আসে গোটা পাড়ায়। |