সিঙ্গুরের পরে হলদিয়া। চার বছর আগে অনুরূপ পরিস্থিতিতেই দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি রতন টাটা তাঁহার ছোট মোটরগাড়ি ‘ন্যানো’ নির্মাণের কারখানা সিঙ্গুর হইতে সরাইয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবরোধ আন্দোলনের জেরে। মমতা সে দিন বিরোধী নেত্রী। চার বছর পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ও দলের অসহযোগিতা ও বিরূপতায় হলদিয়া বন্দর হইতে বিদায় লইতে বাধ্য হইল জাহাজ হইতে মাল খালাসের সংস্থা এবিজি। সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের স্বার্থরক্ষার নামে টাটার কারখানায় ভাঙচুর চালানো হইয়াছিল, কর্মীদের সন্ত্রস্তও করা হয়। হলদিয়ায় পুলিশ ও প্রশাসনকে ঠুঁটো রাখিয়া বাহুবলীরা এমনকী এবিজি-র কর্মকর্তাদের বাড়িতে হামলা চালাইয়া তাঁহাদের রাজ্যের সীমা ছাড়িতে বাধ্য করে। বন্দর কর্তৃপক্ষের অসহযোগ, পুলিশের নির্লিপ্ত ঔদাসীন্য এবং জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অচলাবস্থা আগেই সৃষ্টি হইয়াছিল। ইহার পর এবিজি হলদিয়া ত্যাগের সিদ্ধান্তও লইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে অনুকূল রাজ্য নয়, এই বার্তাই শারদীয় উৎসবের আবহে দেশময় ছড়াইয়া পড়িল। বার্তাটি পুরাতন, তবে শারদীয় উৎসবও তো পুরাতন, বার বার ফিরিয়া ফিরিয়া আসে। পশ্চিমবঙ্গ জানাইয়া দিল, তাহার উৎসব এবং তাহার শিল্পবিমুখতা, দুইই অটুট রহিয়াছে।
রাজ্যের পক্ষে, রাজ্যবাসীর পক্ষে ইহা চরম দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু রাজ্যের শাসকরা স্পষ্টতই তাহা মনে করেন না। তাঁহারা হলদিয়ার ঘটনাপরম্পরার কোনও দায়িত্ব তো লনই নাই, এবিজি-র হলদিয়া ত্যাগে বিচলিত হওয়ার কোনও লক্ষণও দেখান নাই। যেন তাঁহাদের হাতে রাজ্যে বিনিয়োগে উৎসাহী অনেক শিল্পপতি রহিয়াছেন, যাঁহারা কেবল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্কেত-ধ্বনির জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। এক বার বাঁশি বাজাইয়া দিলেই রাজ্য জুড়িয়া লগ্নির ঢল নামাইয়া দিবেন। হলদিয়ার ঘটনা লইয়া উভয় পক্ষেই চাপান-উতোর চলিয়াছে, থানা-পুলিশ হইয়াছে, মামলা আদালত পর্যন্ত গড়াইয়াছে। গোটা ঘটনাক্রমে রাজ্য প্রশাসন তথা সরকারের ভূমিকা কিন্তু আদৌ সন্তোষজনক ছিল না। হলদিয়ার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান, জেলাশাসক, তাঁহাদের অধীন প্রশাসন এবিজি-র কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট হন নাই। হলদিয়ার নব্য মুকুটহীন সম্রাট সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে সদলবলে দাপাইয়া বেড়াইতে দেওয়া হইয়াছে এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত কার্যত এই নিরাপত্তাহীনতা ও তজ্জনিত অচলাবস্থা দূর করিতে কোনও চেষ্টা করেন নাই। বরং তাঁহার কথায়-বার্তায় ভাবে-ভঙ্গিতে অচলকারীদের প্রশ্রয় দিবার ইঙ্গিতই প্রশাসন পাইয়াছে। এই বিষয়টিই কিন্তু সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক। অন্তত রাজ্যে বিনিয়োগেচ্ছু শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশাসনের ভূমিকা একটি বিপজ্জনক নেতিবাচক বার্তাই প্রেরণ করিতেছে।
রাজ্যবাসীর দুর্ভাগ্য, তাঁহাদের দণ্ডমুণ্ডের যাঁহারা কর্তা, তাঁহাদের বিষয়টি উপলব্ধি করার মতো কাণ্ডজ্ঞানও যেন লুপ্ত হইয়াছে। শাসক গোষ্ঠী ও তাহার অনুগত প্রশাসনের আচরণে ও ভঙ্গিতে একটা বেপরোয়া, ‘বেশ-করিয়াছি’ ভাব। যে-রাজ্য ক্রমাগত লগ্নিকারীদের আতঙ্কে পরিণত হইতেছে, তিন-চার দশক ধরিয়া নূতন বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করিয়া সাবেক পুঁজির পলায়নও সুনিশ্চিত করিয়াছে, তাহার পক্ষে, আর যাহাই হোক, নূতন লগ্নিকারীদের বিতাড়ন করার বিলাসিতা শোভা পায় না। বামফ্রন্ট সরকারের আমলের দীর্ঘ খরা কাটাইয়া পশ্চিমবঙ্গ শিল্পবিনিয়োগে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিবে, এই পরিবর্তনের স্বপ্ন কত দ্রুত ভাঙিয়া গেল। বঙ্গোপসাগরে সেই স্বপ্নের সলিলসমাধির সহিত বাণিজ্যলক্ষ্মীর প্রতিমা-নিরঞ্জনও সাঙ্গ হইতেছে। কিন্তু নিরঞ্জনকারীদের কণ্ঠে ‘পুনরাগমনায় চ’ জাতীয় কোনও মন্ত্র কেহ উচ্চারিত হইতে শুনিতেছে না। শুনিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই। হলদিয়া বন্দরে আজ যাঁহারা শিল্পবাণিজ্যলক্ষ্মীকে বিসর্জন দিতেছেন, তাঁহারা অনাগত আগামীর ঠিকানা জানেন না, অতীতের বদ্ধ জলা ও চেনা গর্তেই নিরাপদ, নিশ্চিন্ত বোধ করেন। ইহাই মহাকরণে তাঁহাদের উত্তরাধিকার। পশ্চিমবঙ্গেও। |